ওয়েব ডেস্ক:
“জাগো যোগমায়া, জাগো মৃন্ময়ী
চিন্ময়ী রূপে তুমি জাগো...
তব কনিষ্ঠা কন্যা ধরণি,
কাঁদে আর ডাকে মাগো…
বরষ, বরষ বৃথা কেঁদে যাই…
বৃথাই মা তোর আগমনী গাই…..”
ওয়েব ডেস্ক: “সেই কবে মাগো আসিলি ত্রেতায়/ আর আসলি নাতো….”, এক কাপ গরম চায়ের পাশে টেবিলে রাখা পুজো সংখ্যার পাতাগুলো উড়ে প্রিয় লেখকের নামটা যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, শত ব্যস্ততার পরেও একবার চোখ বুলিয়ে নিতে ভুলি না। সোশ্যাল মিডিয়া, টু জি, থ্রী জি থেকে ফাইভ জি-র পথ ধরে বড্ড তাড়াতাড়ি বদলে গেছে না চারপাশটা? তবে পরিবর্তনের মাঝেও কিছু অবিনশ্বর আছেই। শহর কিংবা শহর থেকে দূরে শুধু খুঁজে নিতে হয়। সে কি আছে? এক কালে কলকাতার ঘুম ভাঙত গঙ্গাস্নান করে, এখন হয়তো হোয়াটস্ অ্যাপের ম্যাসেজ চেক করি। কালের প্রভাবে গঙ্গাস্নান এখন পাঁজি নির্ভর। সময় বদলেছে, নিয়ম বদলেছে, কিন্তু বাদলায়নি পিতৃ তর্পনের রেওয়াজ। তেমনই সাবেকিয়ানা ছেড়ে হয়তো থিমের পুজোয় ছুটেছে বাঙালি। কিন্তু এখনও একচালায় টলটল চোখের দিকে তাকিয়েই জল আসে বাঙালির।
শোভাবাজার রাজবাড়ি এখনও জানে রথের রশিতে টান দিলে কাঠামোয় মাটি পড়ে। কলকাতার সাবেকিয়ানার দালানকোঠায় তিনি এখনও আটপৌরে শাড়ির ভাঁজে সুসজ্জিত শ্রী শ্রী কাত্যায়নী মাতা ঠাকুরানী। শরতের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতেই কল্পারম্ভের মাধ্যমে সপরিবারে আমন্ত্রণ জানানো হয় তাঁকে। শোভাবাজার রাজবাড়ির বড় তরফ আর ছোট তরফের এই একই নিয়ম চলে আসছে ১৭৫৭ সাল থেকে। ১২ জন পুরোহিত মিলিত হয়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির দালানে সুরু করেছিলেন শারদেশ্বরীর বন্দনা। কৃষ্ণ নবমী তিথি থেকে শুক্ল নবমী পর্যন্ত ঘটে পুজিত হন দেবী মহামায়া। আশ্বিন মাসের শুক্ল ষষ্ঠী তিথিতে উন্মোচন হয় দেবীর মৃন্ময়ী বিগ্রহ। দশ দিন ধরে চলে রামায়ণ পাঠ, চণ্ডীপাঠ, বেদপাঠ, মধুসূদন মন্ত্র জপ।
রাজবাড়ির পূর্বসূরি রাধাকান্ত দেবের নির্দেশ অনুযায়ী এই বাড়িতে একমাত্র স্মৃতিতীর্থ পুরোহিতরাই পুজো করতে পারেন। আগে নাকি দেশের চার প্রান্ত থেকে পুরোহিতরা এই বাড়িতে পুজো করতে আসতেন। এখনও যিনি প্রধান পুরোহিত তাঁকে বিশেষ সম্মান সহকারে পুজোর দিন নিয়ে আসা হয়। আগে ঠাকুর তৈরি হত ঠাকুরদালান সংলগ্ন পাঠশালাতে। এখন অবশ্য ঠাকুরদালানেই ঠাকুর তৈরি হয়। এই সময় বাড়ির নিত্যদেবতা রাধাকৃষ্ণ জিউকে তুলে দিয়ে আসা হত নাটমন্দির সংলগ্ন নবরত্ন মন্দিরে। সেখানেই তাঁর পুজো হত। কালের প্রকোপে হারিয়ে গিয়েছে নাটমন্দির। পুজোর ক’টা দিন রাধাগোবিন্দর তাই স্থান হয় পাঠশালার উপরের তলার ঘরে।
ছোট তরফের পুজোয় মুর্তির বিশেষত্ব আছে। সিংহের গায়ের রং রূপোলী। বলতেই বলে রাজা-রাজরাদের ব্যাপার। এখন যে সিংহকে শুধুমাত্র রূপলী রঙ করা হয়, আগে নাকি তাঁর শরীর ঢাকতে বিদেশ থেকে আনানো হতো রূপোর পাত। সেই পাত সমেতই নাকি মায়ের মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হত। এখন রাজাও নেই রাজ্যও নেই, তাই রূপোলী রঙের বাহনেই তুষ্ট দেবী। আগে প্রতিমার গায়ের রূপোর রাংতার সাজ আসত সূদুর জার্মানি থেকে “ডাক” যোগে। তাই মায়ের ডাকের সাজ কথাটির প্রচলন হয়তো এখান থেকেই। চোখ ধাঁধানো কারুকার্যে রূপো, সোনার সিংহাসনে বসানো হতো মৃন্ময়ী মূর্তিকে।
কিন্তু জাত-পাত, ছোঁয়াছুঁয়ির কথা জানলে আপনি হয়তো একটু বিরক্ত হবেন। পুরুষানুক্রমিক ভাবে ওড়িশার ব্রাহ্মণরা পুজোর কাজ সম্পন্ন করেন। বাড়ির মহিলারা দূর থেকে নির্দেশ দেন শুধু। এই বাড়ির বৈশিষ্ট হল, নবকৃষ্ণ দেবের সময় থেকে যাঁরা এ বাড়িতে নিত্যপুজো, ঠাকুরদালান দেখাশোনা বা নায়েবের কাজ, এমনকি বলি দেওয়ার কাজ করতেন, তাঁদের উত্তরপুরুষরা বিগত নয় পুরুষ ধরে এই বাড়িতে রয়ে গিয়েছেন এবং একই কাজ করছেন।
একসময় গোটা কলকাতার মানুষ জানতে পারতো রাজবাড়িতে সন্ধিপুজো শুরু হয়েছে। সশব্দে কামান দাগদেন রাজপরিবারের প্রধান সদস্য। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন লর্ড ক্লাইভ। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে বর্ণিত আছে। অশুভ শক্তির বিনাশ করতে, দেবী মহামায়া চামুন্ডা রূপে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। অষ্টমী তিথির শেষ ৪৮ মিনিট ও নবমী তিথি শুরুর প্রথম ৪৮ মিনিট জুড়ে ঘরের মেয়ে উমা বন্দিত হন অসুরনাশিনী উগ্র চামুন্ডা রূপে। তবে কালের গর্ভে এখন আর কামন দাগে না রাজবাড়ি। শহরের শব্দ দূষণে গ্রাসে গিয়েছে সবই। তাই খেলনা বন্দুকের শব্দেই এখন শুরু হয় সন্ধিপুজো।
রক্ত ছাড়া নাকি শক্তির আরাধনা অসম্পূর্ণ। এক সময় প্রথা মেনে নবমী তিথিতে রাজবাড়িতে বয়ে যেত আস্ত ছাগলের রক্তের স্রোত। মাতৃমূর্তি হয়তো মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী সত্ত্বায় প্রকাশ পেয়েছিলেন ওই নৃসংশতা বন্ধ করতে। এক বার বলির সময় হাঁড়িকাঠ থেকে ছাড়া পেয়ে কী ভাবে একটি পাঁঠা সোজা রাধাকান্তদেবের পায়ের কাছে এসে আশ্রয় নেয়। আশ্রয়প্রার্থীকে আর মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে রাজি হননি রাধাকান্ত দেব। কিন্তু রক্ত ছাড়া যেহেতু শক্তির আরাধনা হয় না তাই পণ্ডিতদের বিধানে পাঁঠার বদলে মাগুর মাছ বলি দেওয়া শুরু হয় সে দিন থেকে। তবে ছোট তরফে এখনও একই নিয়ম চলে আসছে। সপ্তমী থেকে নবমী তিনদিনই ছাগ বলি হয় সেখানে।
অব্রাহ্মণ হওয়ায় শোভাবাজার রাজবাড়িতে অন্নভোগের আয়োজন হয় না। বালুসাই, দরবেশ, মতিচূড়, ল্যাংচা, পাকুলি, খাস্তা কচুরি, শিঙারা ইত্যাদি ভোগ হিসাবে বিখ্যাত। এখানকার খাস্তা কচুরি আর শিঙারা তৈরি হয় শুধুমাত্র ডালের পুর দিয়ে। যে সময় পুজো আরম্ভ, অর্থাৎ ১৭৫৭ নাগাদ বাঙালির হেঁসেলে আলু অপরিচিত ছিল। সেই নিয়ম মেনে এখনও পুজোর কোনও কিছুতে আলু দেওয়া হয় না। ষষ্ঠীর দিন বাড়ির মেয়ে-বউরা ব্রত রাখেন বলে এই দিন কুমড়োর ছক্কা, লুচি, মিষ্টি দই আলাদা করে শরিক সেবায়েতদের বাড়ি পাঠানো হয়। এই বাড়িতে অন্নভোগ দেওয়া হয় না বলে শুকনো চাল দেবীকে অর্পণ করা হয়। এই চালের উপর কলা, চিনি আর ক্ষীরের মণ্ড সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয়। একে বলে ‘আগা’। এই বাড়ির ছোট তরফে একটা সময়ে বিশাল বিশাল থালায় এক কিলো ওজনের সাদা রঙের মোতিচূড় লাড্ডু ভোগে দেওয়া হত, এর মধ্যে থাকত গোলমরিচ আর এলাচ। বিরাট বড় জিভেগজা, এক আঙুল সমান উঁচু জিলিপি আকারে আয়তনে দেখার মতো ছিল সেই সময়ের ভোগের আয়োজন।
সব শেষে মাকে বিদায় জানানোর পালা। ইচ্ছা-অনিচ্ছা আগামীর আশা নিয়েই শুরু হয় কনকাঞ্জলীর পর্ব। ঠিক যেন ঘরের মেয়ে একবছরের মতো ফিরে যান শ্বশুড় ঘরে।
শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় যেমন কনকাঞ্জলি দেয়, এই বাড়ির দুর্গাও কৈলাশে যাওয়ার সময় কনকাঞ্জলি দেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির দুই তরফেই এই প্রথা প্রচলিত আছে। আগে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা আঁচল পেতে কনকাঞ্জলি নিতেন। সোনা-রুপোর মুদ্রা, চাল, এসব দেওয়া হত কনকাঞ্জলিতে। এখন আর সোনা-রুপোর মুদ্রা নয়, টাকাপয়সা, চাল এ সবই দেওয়া হয় কনকাঞ্জলিতে। ঠাকুরমশাই দেবীর পিছন দিকে এগুলি ফেলেন। চারদিনের জাঁক জমকের ঋণ যেন পরিশোধ করে দিয়ে ঘরের মেয়ে ফিরে যান নিজের ঘরে। বাড়ির বড়রা ঠাকুরের পিছনে দঁড়িয়ে সেগুলি গ্রহণ করেন। ছোট তরফে মাকে বিসর্জন দেওয়ার আগে বাড়ি থেকে রওনা করার সময় তলোয়ার পুজো করা হয়। মনে করা হয় এই তলোয়ারই সারা বছর পরিবারকে রক্ষা করবে বিপদআপদ থেকে।
এরপর সেই কঠিন প্রথা, দালান জুড়ে আলো করে থাকা মাতাঠাকুরানীর গঙ্গাপথে কৈলাস যাত্রা। সত্তর দশকে যখন কলকাতা অশান্ত হয় রাজনৈতিক কারণে তখন থেকে অস্ত্র নিয়ে শোভাযাত্রা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আগে নিয়ম মেনে নীলকণ্ঠ পাখি ছাড়া হলেও এখন সেই প্রথা বন্ধ। তার বদলে বেলুনে শোলার তৈরি নীলকণ্ঠ বসিয়ে উত্তর মুখ করে সেই বেলুন ছেড়ে দেন বড় তরফ আর মাটির নীলকণ্ঠে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে সেটি ভাসিয়ে দেন ছোট তরফের সদস্যরা। এর পর মাঝগঙ্গায় জোড়া নৌকায় করে ঠাকুর নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়।
পুজো আসে পুজো যায়। স্টাইল, ট্রেন্ড, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, সোশ্যাল মিডিয়া, ঘোরাঘুরি বদলে কলকাতার দুর্গাপুজো এখন ১৫ দিনের প্যাকেজ কার্নিভাল। ভাবছেন ধুলো জমেছে সাবেকিয়ানায়? পর্দা সরিয়ে দেখুন, দালানকোঠায় কুমোরের হাতে কাঁচা ভেজা মাটির গন্ধ না পেলে পুজো পুজো মনেই হবে না।