ওয়েব ডেস্ক: শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে
ভোরের আগমনী।।
শিউলি ঝড়ানো দিন আনে সে
চিরদিনের বাণী।।
ভোরের আগমনী।।
বাণী কুমারের লেখা আলেখ্য, বেতারে কলকাতা ‘ক’, ভোর রাত শেষে একচিলকতে মিঠে রোদ্দুরের সঙ্গে দেখা হয়। বাঙালির মহালয়ার সকালটা এভাবেই শুরু হয়। আকাশ বাতাস পুজোর গন্ধ মেখে হিমালয়ের চূড়ায় অমল আভায় রঙিন হয়ে ওঠে তুষার জটা। সেই ছিটকে পড়া আলো পাথুরিয়াঘাটার ঘোষ বাড়ি ঠাকুর দালানকে ভরিয়ে রেখেছে। পুজোর আর কিছুদিন বাকি, তার আগে ঘোষবাড়ির ঠাকুর দালানের ছবিটা ধরা পড়বে। এখন সেখানে চলছে ঠাকুর গড়ার কাজ।
দালানে বসেই কখন দুপুর পেড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে আসবে। গোলা পায়রার ঝাঁক দল বেঁধে নেমে আসে, ডানা ঝাপটে বেড়ায় উঠোন জুড়ে। এমন সঙ্গীতের আসর অবশ্য প্রায়ই বসে এখানে। কে আসেননি এই বাড়িতে? ওস্তাদ আলাদিয়া খান, বড়ে গুলাম আলি , গহরজান, বিষ্ণু পালুস্কর, আব্দুল করিম খান বিভিন্ন সময়ে এসেছেন, অনুষ্ঠান করেছেন। তিরিশ এর দশকের শুরুতে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স-এর প্রাথমিক চিন্তাভাবনাও শুরু হয় এখান থেকেই। যে বাড়ির সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে রয়েছে গান, মিশে আছে সুর, সেই বাড়ির পুজো তো আর সুর ছাড়া হয় না !
রামলোচন ঘোষের পুজো শুরু হতো ঢোল আর সানাইয়ের সুরে। ঘরের মেয়ে ঘরে এসেছে, মহালয়ার সকাল থেকেই নহবতখানায় সানাইয়ের তালে তাল মেলাত ঢাক। সেই আওয়াজ জানান দিতো, বাবুদের দুগ্গি জননী এসেছেন বছর পার করে। ১৭৮৩ খ্রীষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান রামলোচন ঘোষের পুজোয় পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতে সস্ত্রীক পদার্পন করেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতরসে নিমজ্জিত হয়েছিলেন সাহেব। মঠচৌরি শৈলিতে তৈরি করা হয় ঠাকুর।
চালচিত্রে থাকেন কৃষ্ণ, কালী, জগদ্ধাত্রী। পটশিল্পী আগে আসতেন কলকাতার বাইরে থেকে। নিপুণ তুলির টানে একের পর এক দেবদেবী আর লোকগাথার ছবি ফুটে উঠত পটে। এখন আর সেই সব শিল্পী আসেন না। আগে অষ্টমীতে হতো পাঁঠাবলি, এখন সুন্দর মার্বেল পাথরের থালায় সাজিয়ে দেওয়া হয় ফল মিষ্টি। রুপোর থানায় পরিবেশন করা হয় নিরামিষ ভোগ। পুজো শুরুদিন থেকেই জ্বলতে শুরু করে একটি বিরাট মোমবাতি। আগে মোমবাতির বদলে জ্বালনো হতো প্রদীপ।
প্রতিবছর পুজোর আগে ঠাকুর দালানে পড়ে রঙের পোচ। খসখসে চুনের গন্ধে মিলে যায় প্রতিমা তৈরির ভেজা মাটির গন্ধ। বাড়ির মহিলারা পুজোর জন্য চন্দনের সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করতেন ধুপের মশলা। মোটা করে সেই মশলা কাঠির গায়ে দিয়ে শুকোতে দেওয়া হত। ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে প্রস্তুত হত ঢেঁকি ছাঁটা চাল। আত্মীয় স্বজনরা যখন পুজোর মরসুমে আসতেন বাড়িতে, সেই সময় কাজে লাগত এই চাল। সময় বদলেছে ম্লান হয়েছে ঐতিহ্যও। সারা পুজোয় নিরামিষ খাওয়া হলেও নবমী তিথিতে মাংসের সঙ্গে থাকত তিন রকমের মাছের পদ। বাড়ির গানঘরে এককালে যেখানে আসতেন খ্যাতনামা শিল্পীরা সেখানে এখন শুধুই নিরবতা।