ওয়েব ডেস্ক: বলদে চড়িয়া শিবে শিঙ্গায় দিল হাক।
সিঙ্গাসনী মর্তেতে বাজিয়া উঠল ঢাক।।
শিবের সনে কার্তিক,গনেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী
আশ্বিনমাসে বাপের বাড়ি আসেন ভগবতী।।
গৌরি এলো… দেখে যা লো….
ওয়েব ডেস্ক: বাংলার লোকসঙ্গীতের পাতায় এমন কত গানই আছে। শিব-দুর্গার কাল্পনিক সংসারে মেয়ে-জামাইয়ের আহ্লাদ নিতে উমা, গৌরী, পার্বতী মহাশক্তির অসংখ্যরূপকে ঘরের মেয়ে রূপে বরণ করে নেয় বাঙালি। শহরের মানুষের কাছে উত্তর কলকাতার একান্নবর্তী পরিবার, চুন, সুড়কির দালানকোঠা মানেই ঐতিহ্য আর সাবেকিয়ানা একটুকরো কোলাজ।
পুজোরদিনগুলোয় ঘরের ছেলে-মেয়ের ঘরে ফেরা, আত্মীয় স্বজন আর প্রতিবেশীদের আনাগোনা। কিন্তু কলকাতা থেকে দূরে বহু দূরেও রয়েছে বাঙালীর দুর্গোৎসবের সাবেকিয়ানা। শহর থেকে একদম আলাদা, ভিন্ন স্বাদের। ঐতিহ্য আর সাবেকি আনার সঙ্গে সেখানে মিশে আছে কাঁচামাটির সুবাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে শহর কলকাতায়। শতবর্ষ পরেও অমলীন হয়ে আছে গ্রাম বাংলায় ঐতিহ্যের সেই সব পুজো।
পূর্ব মেদিনীপূরের এগরার দু নম্বর ব্লকের বালিঘাই বারানিধি গ্রামে রায়চৌধুরী, রায় ও দুয়ারী এই তিন পরিবারের দুর্গাপুজোর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রোমাঞ্চকর কাহিনী। প্রথম দুটি জমিদার বাড়ির দুই শরিকের পুজো। তৃতীয়টি প্রতিবাদের ও অধিকার প্রতিষ্ঠার। বারোয়ারি পুজোর দৌলতে এই তিন বাড়ির পুজো কৌলীন্য হারালেও আজও এর ইতিহাস মুখে মুখে ফেরে। অতীত হয়েছে ঘটনা, তবুও জীর্ণ হয়নি ইতিহাস। ষোড়শ শতকে মারাঠা আমলে বেশ কিছু এলাকা জায়গীর পান (বর্তমান এগরা-২ ব্লক এলাকার কিছু অংশ) রায় পরিবার। কিছুকাল পর তাঁদের চৌধুরী উপাধি দেওয়া হয় রায় পরিবারকে।
এই বংশেরই চৌধুরী ফতে সিংহরায়ের আমলেই শুরু হয় মা দুর্গার আরাধনা। তবে ইংরেজ আমলে জমিদারি নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে শরিকি বিবাদ শুরু হয়। রায় পদবি নিয়ে একটি পরিবার চলে আসেন মাধবপুর গ্রামে। অন্য শরিক আসেন বৈঁচা বা বারানিধি গ্রামে। দু’পক্ষই স্থাপন করেন পৃথক গড়। মানসিকতার পার্থক্য , দূরত্বের কারণে বদল আসে পুজোর আচার অনুষ্ঠানেও।
এই পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। উনবিংশ শতকে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা বদল আনে প্রজাদের মানসিকতার মধ্যেও। হঠাৎ-ই পড়তে শুরু করে রায়চৌধুরী পরিবারের অবস্থা। অন্যদিকে ঐতিহ্য আর প্রতিপত্তির শিখর আরোহন করে থাকে রায় পরিবার। জাতপাত, ধর্মীয় অন্ধত্বের আড়ালে নিমজ্জিত ছিল বাঙালীর দুর্গোৎসবের আনন্দ।
রায় পরিবারের পুজোয় অংশগ্রহণ করতে পারতেন না ওই অঞ্চলের সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষেরা। নিজেদের “দলিত” অবহেলিত বলে মেনে নেওয়ার অভ্যাস করে ফেলেছিলেন সেই মানুষগুলি। শোনা যায়, রায় পরিবারে জমিদারী আমলে যারা দ্বাররক্ষক, পাইক, সামন্ত হিসাবে কাজ করতেন তাদের “দুয়ারী” উপাধি দেওয়া হত। পরবর্তীকালে এই দুয়ারীদের মধ্যেই কোন এক দুর্দণ্ডপ্রতাপ বাংলায় নিজের প্রতিপত্তি স্থাপন করেছিলেন। জমিদার বা জায়গীরদারের অধস্তনবৃত্তি করার থেকে স্বতন্ত্র করেন নিজেকে। রায় পরিবারের সঙ্গে টেক্কা দিতে নাকি দুয়ারীরা দুর্গোৎসব পালন করতে শুরু করেন। মহাকাব্যে বর্ণিত আছে রাবণের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে শ্রী রামচন্দ্র ত্রেতা যুগে মহাশক্তির আহ্বান করেন।
“অকাল বোধন”-র সঙ্গে যেন সেই থেকেই জড়িয়ে গেছে রাজকীয়তার আস্বাদ। ঝাড়বাতি, বাঈনাচ, সঙ্গীত সম্মেলন, কামান দাগা, পায়রা ওড়ানো আরও কত কি এমন রীতি-নীতি জড়িয়ে আছে যা আমাদের অজান্তেই পুজোর অঙ্গে পরিনত হয়েছে। রায় ও দুয়ারী বাড়িতে পুজো হয় সতেরো দিনের। জিতাষ্টমী থেকেই ঘটোত্তোলন করে শুরু হয় পুজো। পুজো চলে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত। একচালার প্রতিমা। রীতি, বংশেরই পুরুষ পুরোহিত হয়ে প্রাচীন পুঁথি থেকে মন্ত্র পড়ে পুজো করবেন। রায়রা তা মানলেও অব্রাহ্মণ হওয়ায় মানতে পারেন না দুয়ারীরা।
এক সময় বলি দেওয়ার প্রথা থাকলেও এখন আর তা নেই কোনও বাড়িতেই। রয়েছে শুধু নিয়মনিষ্ঠার কঠোরতা। অন্য দিকে, দুয়ারীদের উত্থানের তিন চার দশক পরে অর্থাভাবে পুজো সংক্ষিপ্ত করলেন রায়চৌধুরীরা। আর্থিক অবস্থার দুর্বিপাকে পুজো সতেরো দিন থেকে নেমে এল একমাত্র নবমীর দিনে। প্রতিমার বদলে পুজো পেলেন ঘট। ‘নিশা পূজা’র বদল ঘটে হল ‘দিবা পূজা’।
অবস্থার পরিবর্তন ঘটল আবার কয়েক দশক পরে। এখন নতুন মন্দিরে একচালায় দীর্ঘদেহী প্রতিমা গড়ে দেবী পূজা পান রায়চৌধুরী বাড়িতেও। শহর ছেয়ে গেছে থিমের পুজোয়। প্রতিযোগিতা থেকে খুব দূরে নেই গ্রামের বারোয়ারি পুজোগুলোও। তবুও পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় এখনও বাসিন্দাদের মুখে মুখে ঘোরে ঐতিহ্যের এই তিন পুজোর নাম, নামেজমিদারের (রায় বাড়ি), প্রতিবাদের (দুয়ারী বাড়ি) ও পুনরুত্থানের (রায়চৌধুরী বাড়ি)।