Date : 2024-04-25

স্বপ্নপূরণ মেসির, মারাদোনার দেশে বিশ্বকাপ

মৈনাক মিত্র, সাংবাদিক : মহাকাব্য রচনা করে তৃতীয় বিশ্বকাপ ঘরে নিয়ে গেল আর্জেন্তিনা। রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে ফ্রান্সকে টাই ব্রেকারে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতলো মেসি – ডি মারিয়ারা। খেলা হল আর্জেন্তিনা বনাম এমবাপে। নাটকীয়তায় মোরা ১২০ মিনিটে এক দল করলো তিন গোল। আরেকদিকে তিন গোল করলেন এমবাপে। তবে বাংলার বহু প্রচলিত প্রবাদ পুরনো চাল ভাতে বাড়ে, কথাটি আরো একবার প্রমাণ করে দিলেন লিওনেল মেসি – অ্যানজেল ডি মারিয়া। সহজ ম্যাচ কঠিন করে হলেও, শেষ মেশ জিতল আর্জেন্টিনাই। ব্রাজিল নাই বা পারলো, আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ যাওয়ার স্বভাবতই ফের একবার ফুটবল মানচিত্রে জ্বলজ্বল করে উঠলো দক্ষিণ আমেরিকার নাম। ম্যাচের শুরু থেকেই জীবনের শেষ বিশ্বকাপে নিজেদের উজাড় করে দিতে থাকেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, লিওনেল মেসিরা। এই দুই তারকাই ফরাসি রক্ষণে মুহুর্মুহু আক্রমন করে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিতে থাকেন। ম্যাচের ২৩ মিনিটে ডি মারিয়াকে বক্সের ভিতর ফাউল করায় পেনাল্টি পায় আর্জেন্তিনা।

স্পট কিক থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন লিওনেল মেসি। ৩৬ মিনিটে ফের গোল। এবার নিল সাদা জার্সিধারিদের হয় দ্বিতীয় গোলটি করেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ২-০ এগিয়ে থেকে লেমন ব্রেকে যায় আর্জেন্তিনা। কিন্তু বিরতির পরই খেলায় ফিরতে মরিয়া হয়ে ঝাঁপায় ফ্রান্স। এক্ষেত্রে অবশ্য ফ্রান্সের কাজ সহজ করে দিলেন আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনী। অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়াকে মাঠ থেকে তুলে নিতেই সেই সুযোগ কাজে লাগলো ফ্রান্স। আর্জেন্তিনার আক্রমনের ঝাঁজ কমে যাওয়ায় পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন এমবাপে – রাবিয়টরা। ৮০ মিনিটে ওতামেন্ডির ভুলে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। গোল করে ব্যবধান কমান এমবাপে। এর এক মিনিটের মধ্যেই ফের গোল।

অনব্যদ ভলিতে মার্টিনেজকে পরাস্ত করে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের সমতায় ফেরান ২৩ বছর বয়সী এমবাপে। নাটক তখনও বাকি ছিল। ২-২ থাকার পর ম্যাচ গরাল অতিরিক্ত সময়। সেখানে ফের একবার মেসি ম্যাজিক। ১০৮ মিনিটে মেসির শট গোললাইন ক্রস করে যায়। ৩-২ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্তিনা। কিন্তু কিলিয়ন এমবাপে বোধয় তখনও বলছিলেন অভি পিকচার বাকি হে। ১১৮ মিনিটে বক্সের ভিতর হাতে বল লাগে মন্টিয়েলের। ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ফাইনালে নিজের হ্যাটট্রিক সম্পূর্ন করে ফ্রান্সকে সমতায় ফেরান সেই এম্বাপে। ম্যাচের ফল দাড়ায় ৩-৩। অতিরিক্ত সময় খেল দেখালেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমীলিয়ানো মার্টিনেজ। বলা ভালো মার্টিনেজের সাজেই বোধয় এদিন জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন প্রয়াত কিংবদন্তি দিয়েগো আর্মন্দো মারাডোনা। কিংসলে কোমানের শট অনবদ্য দক্ষতায় বাঁচালেন মার্টিনেজ। চাপে পড়ে পরের শট মিস করলেন চুয়ামেনী। আর্জেন্তিনার অবশ্য লিওনেল মেসি, পাওলো দিবালা, লিয়ান্দ্র পারেদেস এবং মন্টিয়েল, চার ফুটবলারই টাই ব্রেকারে গোল করলেন। শেষ মেষ ৪-২ গোলে টাই ব্রেকারে ম্যাচ জিতে ৩৬ বছরের খরা কাটাল আর্জেন্তিনা।

স্বপ্নের সওদাগর হয়ে উঠলেন কোচ লিওনেল স্ক্যালোনী। শেষ বেলায় রূপকথা লিখে বিশ্বকাপ জিতলেন এলএমটেন। অবশ্য ট্রাজিক হিরোর মতোই মাঠ ছাড়লেন হ্যাটট্রিক করা কিলিয়ান এমবাপে। ৮ গোল করে পেলেন গোল্ডেন বুট, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ছোঁয়া হল না তার। বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলার হয়ে গোল্ডেন বল পেলেন লিওনেল মেসি। গোল্ডেন গ্লাভস জিতলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। ১৯৯০ এর আর্জেন্তিনা, ১৯৯৮ এর ব্রাজিলের পর এবার ফ্রান্সও টাইটেল ডিফেন্ড করতে পারল না। বিশ্বকাপের ইতিহাসে আর্জেন্তিনা তৃতীয় দল হিসেবে টাই ব্রেকারে বিশ্বকাপ জিতল। ম্যাচ চলাকালীন বারবার ক্যামেরার লেন্স তাক করছিল ডি মারিয়ার দিকে। রিজার্ভ বেঞ্চে বসা ডি মারিয়ার চোখের জলই বলে দিচ্ছিল আর্জেন্টিনার কাছে এই জয়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই আর্জেন্টিনা দলের মারাদোনা যদি হন মেসি, তাহলে ভালদানো অবশ্যই অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে প্রথম দল যারা প্রথমার্ধে একটিও গোলে শট নিতে পারেনি।

বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠ যুব ফুটবলারের পুরস্কার পান এনজো ফার্নান্দেজ। সিজার মেনেত্তির পর কনিষ্ঠতম কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতলেন লিওনেল স্কালোনি । লিওনেল মেসিও একাধিক রেকর্ডের পাশাপশি বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম ফুটবলার হিসেবে গ্রুপ স্টেজ, প্রী কোয়ার্টার ফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি ফাইনাল এবং ফাইনালে গোলের নজির গড়লেন একই বিশ্বকাপে। জিওফ হার্স্ট- এর পর দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে ফাইনালে হ্যাটট্রিক করলেন এমবাপে। ঐতিহাসিক ফাইনালে হ্যাটট্রিক করেও পরাজিত রইলেন এম্বাপে। অপরদিকে গ্রেটেস্ট অফ দা গ্রেটেস্ট এর চেয়ারে পেলে – মারাদোনার পাশেই বসে পড়লেন লিওনেল মেসি। আর্জেন্তিনা এদিন হয়ত খেলতে নেমেছিল ১২ জন নিয়ে। ১১ জন মাঠে, অপরজন ওপর থেকেই ঈশ্বরের বেশে মেসিদের ট্রফি জিতিয়ে হয়ত বললেন ভামোস আর্জেন্তিনা।