Date : 2024-03-28

বাংলা চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার

ঋতব্রত ভট্টাচার্য

কিছু কিছু খবর থাকে তা কারুর কারুর কাছে সু-সংবাদ না দুঃসংবাদ তা মাঝে মাঝে বোঝা দুষ্কর হয়ে ওঠে। যেমন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভারতীয় ছবির এক তালিকা। আবারও অন্যতম শ্রেষ্ট ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে উঠে এল সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ছবি “পথের পাঁচালী”। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফিল্ম ক্রিটিকসের ইন্ডিয়া চ্যাপ্টার একটি সমীক্ষা চালায়। সেখানে সমালোচকদের মতামতের ভিত্তিতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা হিসেবে 10টি ছবিকে তাঁরা বাছাই করেছেন। চলচ্চিত্রে আর্ট ও বিনোদনের অন্যান্য গুণাগুণ বিচার করে সমালোচকরা মেধা, উৎকর্ষ, সিনেমার ভাষা, ফিল্ম ট্রিটমেন্ট-এর উপর ভিত্তি করে ভোটাভুটির মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই তালিকাটি প্রস্তুত করেছেন। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত “পথের পাঁচালি”। এখনও পর্যন্ত দেশে তৈরি হওয়া সেরা ছবি বলে চিহ্নিত করেছেন সমালোকরা। এই 10টি ছবির মধ্যে প্রথম তিনটিই বাংলা চলচ্চিত্র জগতের তিন কিংবদন্তীর। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছেন ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা, এবং মৃণাল সেনের ভূবন সোম।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালী”কে অনেকেই মনে করেন সার্থক সাহিত্যের ততোধিক সার্থক চিত্রভাষার চলচ্চিত্রে প্রকাশ। ১৯৫৫ সালে নির্মিত “পথের পাঁচালি” চমকে দিয়েছিল সবাইকে। অনেকেই মনে করেন ভারতীয় ছবির নব তরঙ্গের কেন্দ্রে “পথের পাঁচালী”। সময় যত পেরচ্ছে ততই এই ধারনা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে ভারতীয় ছবির মাইল স্টোন “পথের পাঁচালী”। এই তালিকার শীর্ষে “পথের পাঁচালী” প্রত্যাশিত। যেমন যথাযথ ঋত্বিক কুমার ঘটক, মৃণাল সেনের উজ্জ্বল উপস্থিতিও।

একবার চোখবুলিয়ে নেওয়া যাক এফআইপিআরএসসিআই-এর বাছাই করা সর্বকালের সেরা 10টি ভারতীয় ছবির তালিকা
১. “পথের পাঁচালী” (সত্যজিৎ রায়)
২. “মেঘে ঢাকা তারা” (ঋত্বিক কুমার ঘটক)
৩. “ভূবণ সোম” (মৃণাল সেন)
৪.”এলিপ্পাথায়াম” (আদুর গোপালাকৃষ্ণণ)
৫. “ঘাটশ্রাদ্ধ” (গিরিশ কাসারাভাল্লির)
৬. “গরম হাওয়া” (এমএস সথ্যু)
৭. “চারুলতা” (সত্যজিৎ রায়)
৮. “অঙ্কুর” (শ্যাম বেনেগাল)
৯. “পিয়াসা” (গুরু দত্ত)
১০. “শোলে” (রমেশ সিপ্পি)

৩০ জন সদস্যদের মতামতের উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে এই সেরা ভারতীয় ছবির তালিকা। গোপন ব্যালটের মধ্যে মতামত দিয়েছিলেন বিশিষ্টরা। ১৯৩০সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ক্রিটিকস নামের এই সংগঠন। দেশে ও বিদেশের (কান,ভেনিস,বার্লিন ইত্যাদি) নানা চলচ্চিত্র উৎসবের অংশ নেওয়া নানা ছবিকে স্বীকৃতি দেয় এই সংগঠন।

শুধুমাত্র ভারতবর্ষে নয় গোটা উপমহাদেশে বাংলার চলচ্চিত্রের একটা আলাদা স্থান রয়েছে এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে বিতর্ক চলতে পারে এখন আছে কি না? কারণ অতীতটা (আমাদের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে) সমৃদ্ধ এবং ঐতিহ্যশালী এটা গোটা বিশ্বই মেনে নিয়েছে। শুধুমাত্র মেনে নেওয়া নয় কান চলচ্চিত্র উৎসব (অর্থাৎ 1956 সালের কান চলচ্চিত্র উৎসব) থেকে শুরু করে (সত্যজিৎ রায়ের) অস্কার পাওয়া, সত্যজিতৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বাংলায় কৃতি চলচ্চিত্রকারদের গোটা বিশ্ব জুড়ে তাঁদের ছবি যেভাবে মানুষ দেখেছে, যেভাবে বিধগ্ধ জনরা সেই ছবি নিয়ে চুল চেরা বিচার করেছে তা আমাদের গর্বের এবং এই উপমহাদেশে বাংলা চলচ্চিত্রের ঐতিহ্যকে তা একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছে। আমরা সবাই জানি এফআইপিআরএসসিআই তাঁদের যে তালিকা সেই তালিকাতে 10টি ছবির মধ্যে 4টি ছবি মহান ত্রয়ী অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেনের পরিচালিত। এবং ওই তালিকাতে আদুর গোপালাকৃষ্ণণ, গিরিশ কাসারাভাল্লির, এমএস সথ্যু, এবং শ্যাম বেনেগালের ছবি তাও যে কোনও না কোনও ভাবে তাঁদের সৃষ্টিশীলতায় এই মহান ত্রয়ীর অনুপ্রেরণা আছে তাও নিঃসন্দেহে বলা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন এই মহান ত্রয়ী একই মহানগরে একই সময় ভারতীয় চলচ্চিত্রকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন সেই ঐতিহ্য কি আজ ভুলন্ঠিত? চলচ্চিত্রের উদ্ভাবনী শক্তির ক্ষেত্রে বাংলা ছবি কি ক্রমশ রসাতলের অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে? অনেকেই মনে করেন সর্বক্ষেত্রে বাংলায় এখন বামনদের যুগ চলছে। এই বামন শরীরে নয় উৎকর্ষ-মেধায়। শাসকের তাঁবেদারি করা বুদ্ধিজীবী আর সরকারি সুযোগ পাওয়ার লোভে গত কয়েক দশকে কলকাতা 71-এর মতো একটাও রাজনৈতিক ছবি হয়নি। এমনকী কেউ লাতিন আমেরিকা কেউবা রুশ দেশের ছবি ঝেড়ে বাংলা বাজারে নাম কিনলেও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবি পর্যন্ত পাঠাতে ভয় পায়। ছবির প্লট আর ফর্ম চুরিতে চৌর্য বৃত্তিতে হলিউড, ইউরোপিয়ান ছবি এবং দক্ষিণ ভারতীয় ছবিকে যে আমরা দশ গোল দিয়েছি এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে বাংলা ছবির যে কৌলীন্য হারিয়েছে তা নিশ্চিত।

প্রশ্ন হচ্ছে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন এই মহান ত্রয়ী একই মহানগরে একই সময় বাংলা চলচ্চিত্রকে যে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিয়েছিল যে উৎকর্ষতায় দেশজ উৎপাদন, দেশজ কাহিনী এবং পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রের কলা কৌশলের প্রকরণকে আয়ত্ত্ব করে এক দেশজ চিত্র ভাষার জন্ম দিয়েছিল পরবর্তীকালে তা কি মুখ থুবড়ে পড়েছে? কোথাও কি সেই বক্স অফিস, তারকা এবং সুড়সুড়ি দেওয়া গল্পে আমরা সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক কুমার ঘটক, মৃণাল সেনের কফিনের পেরেক পুঁতেছি? আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য, বাংলা চলচ্চিত্রের আর্টের তির এখন কি অবহেলিত? এমনকি বাংলার স্বর্ণ যুগে জনপ্রিয় ছবি গুলোর মান এবং উৎকর্ষতা ধারে কাছে আমরা কি আজ পৌঁছতে পারছি? বর্তমানটা শুধুই অন্ধকার? এসব প্রশ্নের উত্তর দেবে কারা?
এই সময়ই দরকার অতীতটাকে রোমন্হন করা। জরুরী ভুলে যাওয়া নাম গুলোকে আবার আলোর সামনে নিয়ে এসে। তপন সিংহ, রাজেন তরফদার, অসিত সেন, অজয় কর….. এদের ঐতিহ্যকে আরো গভীরভাবে অনুভব করা। এটা আশু কর্তব্য। তা না হলে অযোগ্য সন্তানের হাতে পড়ে সাত রাজার ধন যেমন কর্পূরের মতো উবে যায় ঠিক তেমনই হবে বাংলা চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ। তাই সেরা ভারতীয় ছবির সাম্প্রতিক তালিকা বঙ্গবাসীর ক্ষেত্রে চোখ খুলে দেওয়ার বার্তা। অর্বাচীনদের জাগ্রত করার হুশিয়ারি।