সত্যজিৎ চক্রবর্তী, আর প্লাস নিউজ : বাংলাদেশে শুক্রবার কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক সহিংসতার পর মধ্যরাত কার্ফু জারি করে সেনা নামিয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে হিংসা থামানোর ঘটনা শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনে প্রথমবার। সেনা ট্যাঙ্ক ও চপার নামানো আর ফায়ারিং এর শব্দে কার্যত যুদ্ধের চেহারা নিয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সহ দেশটির ১৮টি জেলা । শুক্রবারের সংঘর্ষে অন্তত ৫৬ জন নিহত আর তিনদিনের সহিংসতায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে কাজ করে আসা অফিসিয়ালসরা বলছেন, কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আবেগে ডুবে প্রতারণার শিকার হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং পড়ুয়ারা । বাংলাদেশের সরকার বিরোধী বিদেশি শক্তি দেশটির বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সাথে নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারকে শিক্ষা দিতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় শেখ হাসিনার নাকের ডগায় হিংসার উৎস স্থল সংঘটিত করল নন স্টেট এক্টররা। আর হাসিনা সরকারকে ওল্টাতে ছাত্র আন্দোলনকে আরব স্প্রিং ভেবে খেলায় নেমেছে বিএনপি-জামাত। শেখ হাসিনা পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত ভুল করলেন কি না সেই সত্যিটা হয়ত এখনই প্রকাশ্যে আসবে না। তবে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশ এবং শাসক দল আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের ভূমিকা শেখ হাসিনার মাথা ব্যথা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অন্যদিকে চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্রদের নেতৃত্ব সরকারের আলোচনা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর সমস্যা সমাধানের যাবতীয় ভার এখন বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের উপর। আদালতে শেখ হাসিনা সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত ৩০ শতাংশ কোটা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে । বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেছেন,” সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি ও ছেলেরা গত পাঁচ বছরে গড়ে ৮ থেকে ১২ শতাংশ কোটা পূরণ করেছেন। তারা পরীক্ষা দিয়ে মেধার ভিত্তিতে কৃতকার্য হওয়ার পরেই কোটায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এমনকি কোথায় অপূর্ণ পথগুলি সাধারণ প্রার্থীদের নিয়োগ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটাকমে ১৫ বা ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিতে চলেছে সরকার।” এর ফলে বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে করছেন এরপর কোটা সংস্কার আন্দোলনের আর যৌক্তিকতা থাকবে না। ছাত্ররা রাস্তা ছাড়বেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জুড়ে সহিংসতা আন্দোলনের জন্য দায়ী করা হয়েছে বিএনপি ও জামাতকে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব একে ইসলামিক ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়েছে। পুলিশের দাবি জামাতে ইসলামের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিলে এই নাশকতা করেছে। সঙ্গে উস্কানি দিয়েছে বিএনপিও। শুক্রবার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেছেন, “আমরা অরাজনৈতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছি। কোথাও জ্বালাও পড়া ভাঙচুর কে আমরা সমর্থন করছি না যারা এসব করছে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই।” আর বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের দাবি, কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনকে আরব স্প্রিং ভেবে বিএনপি ও জামাত হাসিনা সরকার ওলটানোর খেলায় নেমে পড়েছিল। আন্তর্জাতিক মদতদাতারা যোগাযোগ শুরু করেছিল বলেও দাবি করেছে গোয়েন্দারা। রবিবার শুরু হওয়া আদালতে শুনানি ভরসা এখন হাসিনা সরকারের।
অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই অস্থিরতার দিকে নজর রেখেছে নয়া দিল্লি। তবে আগ বাড়িয়ে কোন পদক্ষেপ বা মন্তব্য করতে চায় না দিল্লি । বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলেই শাসক আওয়ামী লীগ আইএসআইয়ের মদত প্রাপ্ত জামাতের দিকে আঙুল তোলার এই প্রবণতাকে এবার চোখ বুজে মানতে চাইছে না দিল্লি। বিশেষজ্ঞদের মতে এই মানতে না চাওয়ার পিছনে রয়েছে কূটনৈতিক দেনা পাওনার সমীকরণ। শেখ হাসিনা সরকারের সাম্প্রতিক চীনা তাস খেলা তিস্তা মহাপ্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহের কথা সামনে নিয়ে আসা এবং সর্বোপরি শেখ হাসিনার কিছু মন্ত্রীর চীনপন্থী প্রবণতাকে তির্যকভাবেই দেখছে ভারত। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে নয় দিল্লি ঢাকার পাশে থাকার বার্তায় দিয়েছে। সেই সঙ্গে নিজেদের কিছু দাবি তালিকা ও পাঠানোর কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে।
দিল্লি ভাবছে এই মুহূর্তে আগ বাড়িয়ে প্রকাশে হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়ালে বা দেশটির সেনার সঙ্গে সরাসরি সমন্বয় করলে ছাত্র সহ সমস্ততা বাংলাদেশ নাগরিকদের কাছে ভুল বার্তা গিয়ে হাতে বিপরীত হতে পারে।। সূত্রের খবর ,ঢাকা নেতৃত্বের ও নিরাপত্তা সংস্থার বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে পরিস্থিতি দ্রুত শান্ত করতে ভিতর থেকে চেষ্টা করছে দিল্লি। যদিও বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণবীর জসওয়াল বলেছেন ,” এই ঘটনাকে সে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখছি।”
কূটনৈতিক শিবিরের মতে বাংলাদেশের হিংসা ও আইনশৃঙ্খলা চূড়ান্ত অবনতি শুধু সে দেশের বিষয় হতে পারে । তবে তার প্রভাব ভারতের জন্য মঙ্গলজনক নয়। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জি-টুয়েন্টির প্রধান সমন্বয়কারী হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, “বাংলাদেশে যেভাবে অস্থিরতা বেড়ে চলেছে তা খুবই উদ্বেগের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন বিষয়টি কোর্টের বিচারাধীন । আশা করা যায় কোর্ট দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে।”নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিকের কথায়, “বিষয়টি আরো জটিল হয়েছে কিছু ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে নন স্টেট অ্যাক্টররা মিশে গিয়ে হিংসাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এখন প্রয়োজন হিংসা নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি শান্ত করা।”
কূটনৈতিক শিবিরের একাংশের দাবী সম্প্রতি দুবার ভারতে ঘুরে যাওয়া শেখ হাসিনা এই জটিল পরিস্থিতিতে নিজের সরকারকে সুরক্ষিত রাখতে পশ্চিমের সমালোচককে প্রতিহত করতে রাজনৈতিক সমর্থকের জন্য ভারতের দিকে তাকাতে বাধ্য। ভারত সে দেশে নিরাপত্তা সংস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তি সংস্থার সঙ্গে আগাগোড়া যোগাযোগ রেখেছে। নন স্টেট এক্টররা যাতে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতার সঙ্গে ভারত বিরোধিতাকে একই বন্ধনীতে আনতে না পারে সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে।
সূত্রের খবর এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সরকারি কাঠাময়ী কিছু সংস্কারের পরামর্শ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সাউথ ব্লক। যার মধ্যে অন্যতম চীনা পন্থী মন্ত্রীদের সরানো। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে শেখ হাসিনার প্রয়োজন তার মন্ত্রী ও বাহিনীর কিছু অদল বদল করা। দেশের ক্রম বর্ধিত অসন্তোষ হাসিনা সরকারের আগেই আঁচ করা উচিত ছিল। অসন্তোষ শুধু কোটা সংস্কারের দাবিকে ঘিরে নয়। দেশের ক্রমশ ফ্ল্যাট অর্থনৈতিক সমস্যা বৃদ্ধি, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধির মত বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল বা আছে। আজ পরিস্থিতির সামলে নিলেও কাল অন্য কিছু দিয়ে অশান্তি হতে পারে।
দেশটির বর্তমান পরিস্থিতির কারণে রোববার ও সোমবার সরকার সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে।এ বিষয়ে শনিবার (২০ জুলাই) একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ শিবলী সাদিক জানিয়েছেন,”এ সময়, সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি এবং স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
তবে জরুরি পরিষেবা যেমন – বিদ্যুৎ জল, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরসমূহ এবং পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমসহ টেলিফোন, ইন্টারনেট ও ডাক সেবা এবং এই সংশ্লিষ্ট সেবা কাজে নিয়োজিত যানবাহন এবং কর্মীগণ এর আওতাবহির্ভূত থাকবে।এছাড়াও হাসপাতাল, চিকিৎসা কার্যক্রম এবং জরুরি কাজে নিয়োজিত অফিসমূহও এই ঘোষণার আওতাবহির্ভূত।”
সূত্রের খবর, এর বাইরে ব্যাংকগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আদালতের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেবে।চলা সহিংস পরিস্থিতি সামলাতে দেশে জারি করা কারফিউ রবিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে সরকারি ঘোষণা রয়েছে।
আরও পড়ুন : সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনে মৃত বেড়ে ১০৫, ফিরিয়ে আনা হল ২৪০ ভারতীয়কে