সঞ্জনা লাহিড়ী, সাংবাদিক- তরুণ প্রজন্ম নিয়ে চিরকালই চিন্তিত ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাজ্যের শিক্ষিত যুবক- যুবতীরা চাকরির জন্য বাইরে চলে যাবে, তা তিনি কিছুতেই মানতে পারেননি। স্বপ্ন দেখেছিলেন রাজ্যে শিল্প আনার, তা রাজ্যের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলেন। শিল্প ছাড়া রাজ্যের শিক্ষিত তরুণ সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার তা বুঝেই চেষ্টা চালিয়ে গেছিলেন। তাঁর কথায় বারবার উঠে এসেছে, “কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ”। তবে তাঁর সেই স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেল। ক্ষমতায় থাকতে তিনি পারলেন না, এমনকী জীবদ্দশায়ও তিনি দেখে যেতে পারলেন না। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি ছিলেন বিধায়ক।
২০০০ সালে জ্যোতি বসু অবসর নেওয়ার পর তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন। ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর জমানায় ২০০৬ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গড়ার পর শিল্প নিয়ে উদ্যোগী হন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম- নয়াচরসহ একাধিক জায়গায় কারখানা তৈরি করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিক্ষিত যুব সমাজের জন্য শিল্পের গুরুত্ব কতটা তা বুঝতেন তিনি। নতুন শিল্প-কারখানা কর্মসংস্থান করতে পারে বলে রাজ্যের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। রাজ্যে শিল্প আনার জন্য শিল্পপতিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরী বলে মনে করতেন তিনি এবং তা নিজের দলের অন্দরে আলোচনাও করতেন। তবে শিল্প নিয়ে উদ্যোগী হলেও তাঁর সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রয়ে গেছিল বেশ কিছু খামতি। যে কারণবশত বিরোধীরা সাঁড়াশি আক্রমণ করতে পেরেছিল বলে মনে করে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
২০০৬ সালে হুগলির সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো কারখানা, নন্দীগ্রাম-নয়াচরে কেমিক্যাল হাব, শালবনিতে ইস্পাত, কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র করার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন বুদ্ধবাবুর সরকার। সল্টলেক সেক্টর ফাইভে তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র গড়ার জন্যও তিনি শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। শিল্প নিয়ে উদ্যোগী হলেও, বাস্তবায়নে ছিল বেশ কিছু ত্রুটি। সিঙ্গুরের বহুফসলী চাষের জমি নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হলে তা সামাল দিতে পারেনি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। নন্দীগ্রামে পুলিশ অবাধ গুলি চালালেও তা নিয়ে নতি স্বীকার করেননি তিনি। কার্যত ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিলেন তিনি। ফলত দেখা যায় বিরোধীদের আন্দোলন দাগ কাটে রাজ্যবাসীর অন্তরে।
বাম নেতাদের একাংশের উস্কানিমূলক মন্তব্যে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। সিঙ্গুর- নন্দীগ্রামের আন্দোলন থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে বামেরা। ফলস্বরূপ, ২০১১ তে বামেদের দৃষ্টান্তমূলক পতন। এরপর থেকেই রাজ্যে শিল্পের ভবিষ্যৎ ক্রমেই অনিশ্চিত হয়েছে। টাটা গোষ্ঠী চলে গেছে বহু আগেই। ভারী শিল্পের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলিও চলে গিয়েছে অন্যত্র। বিনিয়োগ প্রায় তলানিতে ঠেকেছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও বিভিন্ন জনসভায় রাজ্যে শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর আক্ষেপ শোনা গেছে। শিল্প নিয়ে তাঁর স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল।