মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আরজিকরে তরুণী চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল বাংলা। একদিকে মৃতার প্রতি সুবিচার এবং মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ঘুঘুর বাসা ভাঙতে টানা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। তাঁদের আন্দোলনকে সর্বতভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করে চলেছেন সিনিয়র ডাক্তাররাও। আন্দোলনে এগিয়ে আসছেন সাধারণ মানুষও। রোদ ঝড় জল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থান করছেন আন্দোলনকারী ডাক্তাররা। তাঁদের জন্য জল, খাবার সহ সমস্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। এখানেই শেষ নয়। তাঁদের পাশে বলে স্লোগান দিয়ে মনোবলও বাড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষজন। কখনও আন্দোলনমঞ্চে বোমাতঙ্ক, কখনও আন্দোলনমঞ্চে হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে অডিও ক্লিপ প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু তা সত্বেও দমানো যায়নি জুনিয়র ডাক্তারদের। ৫দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনে অনড় তাঁরা। এদিকে বিষয়টি ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনা করে মিটিয়ে নিতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু আন্দোলনকারী ডাক্তাররা লাইভ স্ট্রিমিং ছাড়া আলোচনায় রাজি নন। সেজন্যই ভেস্তে যায় আলোচনা। এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ শনিবার মুখ্যমন্ত্রী নিজে ছুটে যান ডাক্তারদের আন্দোলনমঞ্চে। সেখানে দোষীদের শাস্তির পাশাপাশি একগুচ্ছ পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়ে ডাক্তারদের আলোচনার আহ্বান জানান তিনি।
গত এক মাসে, একটা স্লোগান মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। বিচার যত পিছোবে, মিছিল ততোই এগোবে। হচ্ছেও তাই, সময়ের সাথে সাথে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে প্রতিবাদ, জমায়েত। কোনও মিছিল স্লোগানে মুখরিত, কোনও মিছিলে আবার সুরে সুরেই হয়েছে প্রতিবাদ। কোনওটা আবার মৌন মিছিল। কোথাও আবার তুলির টানে ছবি এঁকে কিংবা রাস্তায় গ্র্যাফিটি এঁকে প্রতিবাদ হয়েছে। কোথাও টলমল পায়ে শিশুরা হেঁটে বেড়াচ্ছে মিছিলে, হাতে ঘুরছে ‘ওই ওয়ান্ট জাস্টিস’ (We Want Justice) পোস্টার। কোথাও আবার বাবা-মায়েদের কোলে চেপে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আরজিকরের নির্যাতিতা তরুণীর হত্যার সুবিচার চাইছে।
অন্যান্য বছর পুজোর আগে যে ছবিটা উঠে আসত তা হল, শপিং, খাওয়া দাওয়ায় মত্ত শহরবাসী। কিন্তু ২০২৪-এর দুর্গোৎসবে নাগরিকদের প্রস্তুতি যেন অনেকটাই ফিকে। এখনকার রবিবার শপিং বা, দুপুরে ভাতঘুম দেওয়ার মতো ছুটির দিন নয়। রবিবার মানেই প্রতিবাদ, উই ওয়ান্ট জাস্টিস স্লোগান দিয়ে আন্দোলনকারী ডাক্তারদের পাশে দাঁড়ানো। কোনও পাড়ার মোড়ে আবার রাত দখলের ভিড়ে অশীতিপর বৃদ্ধ, কোথাও আবার মা বাবার হাত ধরে জাতীয় পতাকা নিয়ে নামছে কচিকাঁচারা। সবমিলিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষজন নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী সামিল হচ্ছেন প্রতিবাদে। কারণ একটাই, সমাজের এই দম বন্ধ করা পরিস্থিতিতে ঘরে বসে থাকাটাকে অনেকেই বিলাসিতা মনে করছেন।
এর আগে এমন গণ আন্দোলনের সাক্ষী থাকেনি কলকাতা। মিছিল-প্রতিবাদ আগেও হয়েছে, কিন্তু সমাজের সব স্তরের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়নি কোনও ঘটনা। আট থেকে আশি, বাঙাল থেকে ঘটি, নারী থেকে পুরুষ, এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজনও আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। সমাজ বিশ্লেষকদের অনেকের মত, আরজি করের ঘটনা আসলে শুধুই ধর্ষণ কিংবা খুনের ঘটনা নয়, একই সঙ্গে নারী নিরাপত্তা, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, সরকারি হাসপাতালে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির বিষয়গুলি সামনে নিয়ে এসেছে। সেজন্যই এত বড় আকারে প্রতিবাদ হচ্ছে। একটা কথা পরিষ্কার। এই আন্দোলন সংগঠিত নয় বরং অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত।
আরজিকরকাণ্ডের প্রতিবাদ আন্দোলনে সমস্ত স্তরের মানুষের মিলে যাওয়াটা একেবারেই নজিরবিহীন। প্রতিবাদের নিত্যনতুন ছবি উঠে আসছে আন্দোলন থেকে। যেমন শিরদাঁড়া নিয়ে লালাজার অভিযানে সামিল হয়ে নগরপালকে সেই শিরদাঁড়া উপহার দেন ডাক্তাররা। এখানেই শেষ নয়, মগজাস্ত্র নিয়ে স্বাস্থ্যভবন অভিযানে দেখা গিয়েছে ডাক্তারদের।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রাজ্যবাসীকে উৎসবে ফেরার বার্তা দিয়েছেন তখন স্বাস্থ্যভবনের সামনের অবস্থান মঞ্চেই ঢাক, কাঁসর বাজিয়ে উৎসবের মেজাজে স্লোগান তুলেছেন আন্দোলনকারীরা।আরজিকরকাণ্ডের প্রতিবাদের আন্দোলনে যেটা সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে তা হল স্লোগান। প্রতিদিনই উঠে আসছে নিত্যনতুন স্লোগান এবং পোস্টার।স্বাস্থ্যভবনের সামনে ডাক্তারদের অবস্থানে উঠেছে, বিচার তোমায় দিতে হবে, নইলে গদি ছাড়তে হবে স্লোগান।নাগরিক সমাজের প্রতিবাদে স্লোগান উঠেছে, তিলোত্তমার রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ। নাটক ছেড়ে বিচার করো আরজিকরের মাথা ধরোর মতো স্লোগান।
ইস্টবেঙ্গল মোহন বাগানের বিক্ষোভে উঠেছে অভিনব দুটি স্লোগান। ঘটি বাঙাল একই স্বর জাস্টিস ফর আরজিকর। তিনদলের একই স্বর জাস্টিস ফর আরজিকর।দেশ পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে, আগুনের পরশমণি গান পেয়ে টরন্টোতে প্রতিবাদ করেছেন বাঙালিরা। ফিনল্যান্ডে উঠেছে বিশ্বজুড়ে উঠছে ঝড়, জাস্টিস ফর আরজি কর স্লোগান। উই শ্যাল ওভারকাম গেয়ে প্রতিবাদ করেছেন মানুষজন।অরিজিৎ সিংয়ের গাওয়া আর কবে গানে গলা মিলিয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের প্রবাসী বাঙালিরা।
আরজি করকাণ্ডে যখন উত্তাল বাংলা, তখন সিপিএম-বিজেপি স্লোগান দিচ্ছে ‘দফা এক দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ।’ যে স্লোগানকে সামনে রেখে সম্প্রতি বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের আশ্রয়ে থাকতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে। অনেকেই মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের স্লোগানই মূলত দাপট দেখাচ্ছে এই বাংলার রাজনীতিতে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ, বিভিন্ন মহলে অধিকাংশ মানুষই একমত যে, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের স্লোগানের পশ্চিমবঙ্গীকরণ চলছে। আর তা জনপ্রিয়ও হচ্ছে। বাংলার আন্দোলনেও রাজনৈতিক স্লোগানের ইতিহাস দীর্ঘ। স্বাধীনতার আগে থেকে তা চলে আসছে। বাংলা তথা বাঙালির দেওয়া স্লোগান জাতীয় স্তরের স্লোগানে রূপান্তরিত হয়েছে। সেসব স্লোগান কালোত্তীর্ণ হয়ে থেকেছে।
তেভাগা আন্দোলনের সময়ে ‘লাঙল যার, জমি তার’ স্লোগান কৃষক আন্দোলনে সাড় ফেলেছিল। ষাট বা সত্তরের দশকে বামেদের রাজনীতি ছিল মূলত জমিকেন্দ্রিক। নকশালবাড়ি আন্দোলনে আবার চিনা কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন স্লোগানের বঙ্গীকরণ করা হয়েছিল।এ পার বাংলায় বাম জমানার দীর্ঘ সময়ের একটা বড় অংশে নতুন স্লোগান সে ভাবে তৈরি হতে দেখা যায়নি। ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে বামফ্রন্টের স্লোগান ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ রাজ্য রাজনীতিতে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। ২০০৯ সাল থেকে পরিবর্তন চাই, মা-মাটি-মানুষ স্লোগান আলোড়িত করেছিল বাংলার রাজনীতিকে।
আরজি কর-কাণ্ডে অরাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্লোগান উঠছে, ‘তোমার স্বর, আমার স্বর, আরজি কর আরজি কর’। এই স্লোগানের মধ্যেও ‘তোমার নাম, আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’-এর ছায়া রয়েছে বলে অনেকের মত।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান হোক বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন বা কোটা আন্দোলন। সব ক্ষেত্রেই ওপার বাংলার স্লোগান তীব্র প্রভাব ফেলেছে। ‘বুকের ভিতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার হওয়া কনটেন্টের মধ্যে এক নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের কোটা আন্দোলনে ওঠা এই স্লোগান। কোটা আন্দোলনের সময় হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন, কোটা মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা পাবেন না তো কি রাজাকারের নাতিরা পাবে ? হাসিনার মন্তব্যে আরও ক্ষেপে গিয়ে আন্দোলনকারীরা স্লোগান দেন, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’ ।‘ভয় পেলে তুমি শেষ, রুখে দাঁড়ালে বাংলাদেশ’।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ লক্ষাধিক মানুষের মাঝে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের মাধ্যমে তাকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মানুষজন। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানান, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ সেসময়ে জনতার মধ্যে উঠে এসেছিল ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ স্লোগান। জনতার মধ্যে ওঠে ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো স্লোগানও।’
এ ভাষণের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। ভাষণের মাধ্যমে তিনি বাঙালিকে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সবমিলিয়ে আন্দোলন, প্রতিবাদ, স্লোগান সবই সৃষ্টিশীল বাঙালির সঙ্গে ওথপ্রতভাবে জড়িত। যাতে বহুবার মিলে মিশে একাকার হয়েছে দুই বাংলা।