মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ৮ অগাস্ট প্রয়াত হয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাজ্যজুড়ে তখন প্রিয় কমরেডকে বিদায় জানানোর তোরজোড় চলছে। রাস্তায় নেমেছিলেন অসংখ্য বাম কর্মী সমর্থক, বাম ছাত্রযুব এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শয়ে শয়ে অনুগামী। ৮ অগাস্টের পর ৯ অগাস্টেও শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। তারপর সন্ধের দিকে এনআরএসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দেহ দান করা হয়। গোটা রাজ্যের নজর যখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষযাত্রার দিকে, ঠিক তখনই ঘটে যায় হাড়হিম করা ঘটনা। আরজিকর হাসপাতালে চেস্ট বিভাগে কর্মরত এক মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। প্রথমে বলা হয় আত্মহত্যা করেছেন ওই চিকিৎসক কিন্তু তারপরই বেরিয়ে আসে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। গ্রেফতার করা হয় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে। ঘটনাস্থলে একটি হেডফোনের অংশ মিলেছিল। হেডফোনের সূত্র ধরেই এই গ্রেফতার বলে জানায় পুলিশ। সেমিনার রুমে মহিলা চিকিৎসকের দেহটি যখন উদ্ধার হয়, তখন তাঁর চোখ রক্তাক্ত, শ্বাসরোধ করে খুন করায় কালশিটে দাগ গলায়, যোনিদ্বারেও ক্ষতচিহ্ন মিলেছে। সবমিলিয়ে ধর্ষণ করে খুনের লক্ষণ যখন স্পষ্ট, তখন আত্মহত্যা বলে কেন চালানো হচ্ছিল ? এমনই একাধিক প্রশ্ন ওঠে। নির্যাতিতার দেহটি যেভাবে মিলেছিল, সেই অত্যাচার ও খুন কোনও একজনের কম্ম নয় বলেও স্পষ্ট। তবে কেন একজনকে গ্রেফতার করা হল ? একজন সিভিক ভলান্টিয়ার হাসপাতালের ভিতরে সেমিনার রুমে কী করছিল ? হাসপাতালের ভিতরে তার এমন অবাধ যাতায়াত কী করে হতে পারে? প্রশ্ন তুলে আন্দোলনে সরব হন আরজিকরের চিকিৎসক পড়ুয়ারা। আরজিকরের পাশাপাশি আন্দোলন অবস্থান করেন রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। একে একে আন্দোলনে সামিল হন বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষজন। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি আইনজীবী, বিনোদন জগতের তারকা, কলাকুশলী, চিত্রশিল্পী, নাগরিক সমাজ কেউই বাদ জাননি। উই ওয়ান্ট জাস্টিস, স্লোগানে গলা মিলিয়ে একদিকে যেমন আন্দোলনে সামিল হয়েছে খুদেরা তেমনই রয়েছেন বয়স্করাও। জাতি ধর্ম, লিঙ্গ, বয়স নির্বিশেষে আন্দোলন করছেন সকলে। এককথায় সাম্প্রতিক অতীতে এমন আন্দোলন বাংলার মানুষ কবে দেখেছেন, তা মনে করাটা বেশ কঠিন।
চিকিৎসক হত্যাকাণ্ডে পরিবারকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করার চেষ্টার অভিযোগও উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ। ঘটনার পর মৃতার মা বাবার সঙ্গে কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১২ অগাস্ট সোমবার মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দেন, পুলিশ যদি রবিবারের মধ্যে তদন্তে কিনারা করতে না পারে তাহলে তিনি নিজেই মামলাটি সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেবেন। এরইমধ্যে আরজিকরকাণ্ডে সুবিচার চেয়ে একাধিক মামলা হয় কলকাতা হাইকোর্টে। প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ ওঠে। তারপর ১৩ অগাস্ট মামলাটি সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয় প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের ডিভিশন বেঞ্চ। আরজিকরের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ জড়িত বলেও অভিযোগ তোলেন একাংশ। ক্রাইম সিনে একাধিক মানুষের ঢুকে পড়া নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তাঁরা সকলেই সন্দীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ বলেও উঠে আসে বিভিন্ন মহলে। প্রতিবাদ বিক্ষোভের আবহে আরজি করের অধ্যক্ষ পদ থেকে সরে দাঁড়ান সন্দীপ ঘোষ। কিন্তু নির্যাতিতার বাড়িতে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দীপ ঘোষকে কার্যত ক্লিনচিট দেন। সন্দীপকে আরজিকর থেকে চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পদে বদলি করা হয়। এরপরই ন্যাশনাল মেডিক্যালের চিকিৎসকরাও সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। সন্দীপ ঘোষ সেখানে কাজে যোগ দেওয়ার আগেই অধ্যক্ষের ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে সন্দীপ ঘোষকে একাধিকবার তলব করে সিবিআই। ১৫দিন প্রায় ১৫০ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর দোসরা সেপ্টেম্বর সন্দীপ ঘোষকে গ্রেফতার করে সিবিআই। আর জি কর-কাণ্ডে সন্দীপ ঘোষ ছাড়াও ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার সন্দীপ ঘোষের দেহরক্ষী আফসার আলি এবং হাসপাতালের ভেন্ডর সুমন হাজরা এবং বিপ্লব সিং।
আরজিকরকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ মেয়েদের রাত দখলের সাক্ষী থেকেছে বাংলা। দিনটা ছিল ১৫ অগাস্ট। প্রত্যেকবছর এই দিনটায় মূলত সকাল থেকে যা হয় তা হল লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং ভাষণ। রেড রোডে মুখ্যমন্ত্রীর পতাকা উত্তোলন এবং কুচকাওয়াজ। কিন্তু ২০২৪-এর স্বাধীনতা দিবস ছিল একেবারেই আলাদা। স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগের রাতে মেয়েদের স্বাধীনতার দাবিতে রাস্তায় নামলেন অসংখ্য মানুষ। রাতভর চলল আন্দোলন। উঠল উই ওয়ান্ট জাস্টিস, আই ওয়ান্ট জাস্টিস স্লোগান। আরজিকরের নির্যাতিতার পাশাপাশি মেয়েদের নিরাপত্তার দাবিতেও চলল আন্দোলন। শুধু মেয়েরা নয়, ছেলেরাও সমানভাবে আন্দোলনে সামিল হলেন এবং মেয়েদের স্বাধীনতার দাবি তুললেন। কলকাতার বিভিন্ন রাস্তার পাশাপাশি জেলায় জেলায় পৌঁছে যায় আন্দোলনের আঁচ। এমনসময় ফের বিপত্তি। আন্দোলনের মধ্যেই আরজিকরে ঢুকে গিয়ে ভাঙচুর চালায় দুষ্কৃতীরা। আঁটোসাঁটো পুলিশি নিরাপত্তা সত্বেও কীভাবে এমন ঘটনা ঘটল, ওঠে প্রশ্ন। আরও জোরদার হতে থাকে আন্দোলন। কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের পাশাপাশি পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগের দাবিতে সরব হয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। একদিকে যখন সুবিচারের দাবিতে রাস্তায় মিছিল বের করে বিরোধীরা রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে সিবিআইয়ের কাছে বিচার চেয়ে রাস্তায় নামে শাসকদলও। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও পদযাত্রায় পা মেলান। ১৮ অগাস্ট স্বতঃপ্রণোদিত মামলা গ্রহণ করে সুপ্রিমকোর্ট। এরইমধ্যে আরও তীব্র হয় আন্দোলন। ২৭ অগাস্ট মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে নবান্ন অভিযানের ডাক দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজের তরফে। কার্যত দুর্গের আকার নেয় নবান্ন। বড় বড় গার্ডরেল, কন্টেনার দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে পুলিশ। রণক্ষেত্রের পরিস্থিতি তৈরি হয়। আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে জলকামান, টিয়ার গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। একাধিক আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হয়। পরেরদিন ধৃতদের মুক্তির দাবিতে লালবাজার অভিযানে নামে বিজেপি। তাতেও ধুন্ধুমার হয়।
দোসরা সেপ্টেম্বর নগরপাল বিনীত গোয়েলের পদত্যাগের দাবিতে লালবাজার অভিযানে পা মিলিয়েছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা৷ মেরুদণ্ডের প্রতিকৃতি নিয়ে লালবাজারের সামনে অবস্থান করেন তাঁরা৷ সেসময়ও বড় বড় গার্ডরেল দিয়ে আটকানো হয় আন্দোলনকারীদের। কিন্তু জাস্টিসের দাবিতে রাস্তায় আঁকিবুঁকি কেটে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বহাল রাখেন ডাক্তাররা। প্রায় ২২ ঘণ্টা অবস্থানের পর বিনীত গোয়েলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে মেরুদণ্ড উপহার দেন আন্দোলনকারী ডাক্তাররা। আরজিকর-কাণ্ডের তদন্তে নিজের ভূমিকায় খুশি বলেও চিকিৎসকদের জানান নগরপাল৷
তেসরা সেপ্টেম্বর, রাজ্য বিধানসভায় পাশ হয় ধর্ষণবিরোধী অপরাজিতা বিল। শাসক বিরোধীদের এককাট্টা ভোটে পাশ হয়ে যায় বিলটি। কিন্তু রাজ্য টেকনিক্যাল রিপোর্ট দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সই না করেই অপরাজিতা বিলটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস।
৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের ডিভিশন বেঞ্চে মামলার শুনানি ছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি না আসায় স্থগিত হয়ে যায় শুনানি। ৯ সেপ্টেম্বর ফের সুপ্রিমকোর্টে মামলার পরবর্তী শুনানি। তার আগে অ্রথাৎ রবিবার ফের রাত জাগার ডাক দেওয়া হয়েছে।
আরজিকরকাণ্ডে একযোগে সুবিচারের দাবিতে সরব হয়েছে গোটা বাংলা। সুবিচার কি মিলবে, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।