সহেলী দত্ত, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ২০১৯ সালের ৫ অগাস্ট ভারতের সংসদে একটি বিশেষ বিল পাশ হয়। সংবিধান থেকে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সংক্রান্ত ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা প্রাপ্ত জম্মু-কাশ্মীরকে ভাগ করা হয় কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখে। এরপরই সেখানে শুরু হয় ব্যাপক বিক্ষোভ। ২০১৯ এর শুরুতেই ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছিল কাশ্মীরে। ফেব্রুয়ারি মাসে ২২ বছরের এক যুবক সেনাবাহিনীর কনভয়ে বিস্ফোরক নিয়ে আত্মঘাতী হামলা চালায়। ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত পুলওয়ামায় চালানো এই হামলায় নিহত হয়েছিল অন্তত ৪০ জন ভারতীয় সেনা। হামলাকারী ছিল জইশ-ই-মুহাম্মদ নামে পাকিস্তানভিত্তিক একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ১৯৭১সালের পর ফের সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানের বালাকোট অঞ্চলে বিমান হামলা চালায় ভারত। এই হামলায় ভারতের অন্তত দুটি বিমান বিধ্বস্ত হয় এবং একজন ভারতীয় পাইলটও পাকিস্তানের হাতে আটক হন। ফলে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে ফের যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
বিশ্বের সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি হচ্ছে কাশ্মীর। বিগত ৭৬ বছরে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে তিন দফা যুদ্ধ করেছে ভারত ও পাকিস্তান। আশি দশকের পর থেকে পাকিস্তানের সমর্থন পুষ্ট আন্দোলন, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয়েছে অন্তত ৭০ হাজার মানুষ।
তবে কাশ্মীর নিয়ে কবে থেকে শুরু ভারত পাকিস্তানের এই বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক। তা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক বছর। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভরতবর্ষে ছিল কয়েকশো প্রদেশ ও নেটিভ স্টেট। এরপর ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয় ব্রিটিশরা দ্রুততার সঙ্গে দেশটিকে দুভাগে ভাগ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠ ও ভারত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নিয়ে গঠিত হয়। কিন্তু বিভাজনের পরিণাম হয়ে উঠেছিল মর্মান্তিক। ১৯৪৭ সালের অগাস্ট মাসে ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার আগে কাশ্মীর নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। কারণ কাশ্মীরে বেশিরভাগ মানুষ মুসলিম ছিল এবং তাঁদের শাসক ছিলেন হিন্দু মহারাজা হরি সিং। সেই সময় ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল কাশ্মীর ইচ্ছে করলে ভারত বা পাকিস্তান যেকোনো রাষ্ট্রে যোগ দিতে পারবে। সেই সময় হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে বা ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট বালতিস্তানের মুসলিমরা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে চাইছিলেন। অন্যদিকে মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে পারে এই আশঙ্কা থেকে ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে, পাকিস্তানের পশ্চিম উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলোর যোদ্ধারা অভিযান চালায় কাশ্মীর উপত্যকায়। সেই সময় হরিসিং কাশ্মীরকে ভারতে যোগ দেওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ভারতও সময় নষ্ট না করে সামরিক বাহিনী পাঠায় কাশ্মীরে। যার ফলে১৯৪৭ সালে শুরু হয় প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে ভারত। এরপর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় কাশ্মীরে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর হয়। তবে সেনা প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানায় পাকিস্তান। জাতিসংঘের ৪৭ নং প্রস্তাবে কাশ্মীরে একটি গণভোট আয়োজনের কথা বলা হলেও, তাতে দুই দেশেরই ছিল চরম অনীহা। কাশ্মীরের বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান হওয়ায়, পাকিস্তান চাইছিল কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হোক। তবে ভারতও নিজেদের দাবি ছাড়তে নারাজ ছিল। ফলে সেই গণভোট আর অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে কাশ্মীরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার জন্য দুই দেশের ছিল সমান তৎপরতা। এরপর একই কারণে ১৯৬৫ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। উভয়পক্ষেরই হাজার হাজার সেনার মৃত্যু হয় এই যুদ্ধে। এরপরও দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও ১৯৭১ সালে ফের মুখোমুখি হয় ভারত পাকিস্তান। এবারে সরাসরি কাশ্মীর ইস্যু না হলেও উপলক্ষ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানকে পরাজিত করলে জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ বাংলাদেশ। এরপর পাকিস্তানের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কাশ্মীর। ১৯৭২ এর সিমলা চুক্তির মধ্য দিয়ে বর্তমানে কাশ্মীরের লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখা চূড়ান্ত রূপ পায়। এই নিয়ন্ত্রণ রেখার পাশে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে চলছিল দুই দেশ। ১৯৮৪ সালে ভারত সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ১৯৮৭ সালে একটি বিতর্কিত স্থানীয় নির্বাচনের পর কাশ্মীরের পরিস্থিতি ভয়াবহ অবনতি হতে শুরু করে। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে সেখানকার বহু মানুষ। শুরু হয় তুমুল বিক্ষোভ। ভারত সরকারও এদের দমনে ভীষণ কঠোর হয়ে ওঠে। যার জেরে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে শুরু করে। এই সময় জম্মু ও কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট বা জেকে এল এফ নামে একটি সংগঠনের উত্থান ঘটে। কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য তারা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। বার বার ভারতীয় সেনার উপর হামলা হচ্ছিল। ভারত অভিযোগ করে পাকিস্তান সীমান্তের ওপার থেকে যোদ্ধাদের পাঠাচ্ছে। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। ১৯৮৯ সালের পর নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে কাশ্মীরের বিদ্রোহ। এই সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কমপক্ষে পাঁচ লাখ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করে ভারত। সশস্ত্র বিদ্রোহী বা নিরীহ প্রতিবাদকারী সবার উপর চড়াও হতে শুরু করে তারা। মৃত্যু হয় বহু নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের। ১৯৯৮ সালে ভারতের পর পাকিস্তানও চালায় পরমাণু বোমার সফল পরীক্ষা। আর কাশ্মীর হয়ে ওঠে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের যুদ্ধের ময়দান। ১৯৯৯ সালে ফের আরেকবার যুদ্ধে জড়ায় ভারত পাকিস্তান। তবে এর পরেও কাশ্মীরের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ভারতের পার্লামেন্টে হামলার ঘটনায় প্রাণ হারান দশ জন। এই হামলার জন্য পাকিস্তান ভিত্তিক সংগঠন লস্করী তৈয়েবাকে দায়ী করে ভারত। এরপর ২০০৮ সালে মুম্বই হামলায় ১৮৮ জনের প্রাণহানির ঘটনায় আবারো উঠে আসে লস্করী তৈয়েবার নাম। কাশ্মীরকে ঘিরে যেন সহিংসতার একটা চক্রে আচকে গেছেন সেখানে। একদিকে ভারতীয় বাহিনীর নিপীড়নের শিকার হওয়ায় অনেক কাশ্মীরই যোগ দেয় পাকিস্তান ভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিতে। আবার তারাই আবার সহিংসতা চালায় ভারতীয় সেনাদের উপর। কাশ্মীর সংকট শুরুর ৭৬ বছর পরও কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থানে কোনও পরিবর্তন আসেনি। দুই দেশের এই অবস্থানের জন্য ভুক্তভোগী হয়েছেন সেখানকার সাধারণ মানুষ। চাপা পড়ে গিয়েছে সেখানকার মানুষের চাওয়া-পাওয়া। তবে এই সমস্যা যে এতো তাড়াতাড়ি মিটবে না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।