নারায়ণ দে, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মতোই নাকি ভারত অধিকৃত জুনাগড়। সম্প্রতি এধরনের মন্তব্য করেই নতুন করে বিতর্ক শুরু করলেন পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মুমতাজ জাহরা বালোচ। একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি দাবি করেন, ১৯৪৮ থেকে জুনাগড় কব্জা করে রেখেছে ভারত। যে শহরটি ভারতের গুজরাতে অবস্থিত। কিন্তু পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মতো পাকিস্তানের সঙ্গে সীমানা ভাগ করে না এই শহর। কিন্তু কীভাবে এমন দাবি করতে পারেন পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রক? জুনাগড় শহরের ইতিহাস কী? কীভাবেই বা ভারতের অন্তর্ভুক্তি হল এই শহর। তার আগে দেখে নিন, জুনাগড় নিয়ে অতিসাম্প্রতিককালে পাকিস্তানের ঠিক কী বক্তব্য ?
জুনাগড় নাকি পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। ভারত নাকি রাষ্ট্রসংঘ ও আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে তা দখল করে রেখেছে। বক্তা পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মুমতাজ জাহরা বালোচ। কাশ্মীরের মতোই নাকি জুনাগড় একটি অসমাপ্ত এজেন্ডা। তিনি আরও জানান, এই বিষয়টি নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় পাকিস্তান। নির্বাচনের নামে প্রহসনের পর বর্তমানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন শাহবাজ শরিফ। তাঁর রাজত্বকালে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ অস্থিরতা কাটার নামই নিচ্ছে না। একদিকে ইমরান খানের জেল মুক্তির দাবি যখন দেশ জুড়ে জোড়ালো হচ্ছে, ঠিক সেই সময় পাক বিদেশ মন্ত্রকের এই বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
জুনাগড় শহরের ইতিহাস
ব্রিটিশরা যখন ভারত ছেড়ে যায়, তখন দেশে ৫৬৫টি এমন রাজ্য ছিল যেখানে রাজতন্ত্র চলছিল। ওইসমস্ত রাজ্যগুলিকে ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আবার স্বাধীন থাকার বিকল্প প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশিরভাগ রাজ্যই ভারতের অন্তর্ভূক্তিতে রাজি ছিল। কিন্তু বিতর্কিত কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল জম্মু ও কাশ্মীর, হায়দরাবাদ এবং জুনাগড়। ভৌগোলিকভাবে ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বেষ্টিত জুনাগড়। ১৯৪৭-এ জুনাগড়ের নবাব ছিলেন তৃতীয় মুহাম্মদ মহাবত খান। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে জুনাগড়কে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল হিন্দুদের। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যবাসী নবাবের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। ফলে দেশভাগ পরবর্তী সময়ে এই ছোট শহরটি নিয়েও উত্তাল হয়েছিল ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। রাজ্যবাসীর বিরোধিতাকে উপেক্ষা করেই ১৯৪৭-এর ১৫ সেপ্টেম্বর জুনাগড়ের পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্তি করেছিলেন নবাব তৃতীয় মুহাম্মদ মহাবত খান। যদিও তিনি জানতেন তাঁর এই সিদ্ধান্তে রাজ্যজুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আরও বাড়বে। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। জুনাগড়বাসীর সহযোগিতায় ওই শহরের জন্য একটি সমান্তরাল ভারতীয় সরকার গঠন করা হয়েছিল মুম্বইয়ে। ওই সরকার কূটনৈতিকভাবে জুনাগড়ের কিছু কিছু অংশ দখল করতে সক্ষম হয়। এক সময় ব্যাপক জনরোষের মুখে পড়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান জুনাগড়ের নবাব।
পাকিস্তানে পালিয়ে যান জুনাগড়ের নবাব
পাকিস্তানে যোগদানের সিদ্ধান্তের পর জনসাধারণের অসন্তোষ বাড়ছিল। ভারতের তরফে সামরিক পদক্ষেপের হুমকিও ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু জুনাগড়ের চারপাশে সেনা মোতায়েন করেছিলেন। ১৯৪৭-এর ২৫ অক্টোবর হঠাৎ চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। একাধিক স্ত্রী, সন্তান, পোষ্য এবং সোনাদানার বাক্স নিয়ে কেশোদ বিমানবন্দরে এসে হাজির তৃতীয় মুহাম্মদ মহাবত খান। শোনা যায়, তিনি করাচিতে পালিয়ে যেতে এতটাই তাড়াহুড়ো করেন যে ভুলবশত দুজন স্ত্রীকে বিমানবন্দরে ফেলে রেখেই ব্যক্তিগত বিমানে উঠে পড়েছিলেন। মহাবত খান তাঁর বাকি জীবন পাকিস্তানেই কাটান। করাচির ফাতিমা জিন্নাহ রোডে জুনাগড় হাউস গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৫৯-এর নভেম্বরে মারা যান তিনি। এদিকে ১৯৪৭-এর ১১ নভেম্বর ভারত সরকার পুরোপুরিভাবে জুনাগড়ের দখল নেয়। ১৯৪৮-এ শহরটিকে সৌরাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্তি করা হয়।
গণভোটের মাধ্যমে জুনাগড়ের অধিগ্রহণ
ভারত জুনাগড়ের সামরিকভাবে দখল নিলেও রাষ্ট্রসংঘের নীতি মেনেই গণভোটের মাধ্যমে অধিগ্রহণ করেছিল। ১৯৪৮-এর ২০ ফেব্রুয়ারি গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই ভোটে জুনাগড়ের ২ লক্ষ ১ হাজার ৪৫৭ জন বাসিন্দা অংশগ্রহণ করেছিল। ভারতের পক্ষে ভোট পড়েছিল ১ লক্ষ ৯০ হাজার ৮৭০টি। অন্যদিকে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট পড়েছিল মাত্র ৯১টি। শুধু জুনাগড়েই এই গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। প্রতিবেশি পাঁচটি রাজ্যেও গণভোট করানো হয়েছিল, এই মর্মে যে জুনাগড়কে ভারতের রাজ্য হিসাবে মেনে নেওয়া হবে কী না। মোট ৩১ হাজার ৪৩৪টি ভোটের মধ্যে মাত্র ৩৯টি ভোট পড়েছিল বিপক্ষে। অর্থাৎ মাত্র ৩৯ জন জুনাগড়কে ভারতের অংশ হিসাবে মেনে নিতে চাননি। যদিও গণসম্মতিতেই জুনাগড় শহরটি ভারতের অন্তর্ভূক্তি করানো হয়। কিন্তু পাকিস্তান নবাবের চুক্তিতেই আটকে পড়ে আছে। দেশটি আজও আন্তর্জাতিক স্তরে জুনাগড়কে পাকিস্তানের অংশ হিসাবে দাবি করে আসছে।
পাকিস্তানের মানচিত্রে জুনাগড়ের উল্লেখ
জুনাগড়কে পাকিস্তানের অংশ হিসাবে দেখিয়ে বছর চারেক আগে মানচিত্র প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন পাক-প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ২০২০-এ পাকিস্তানের রাজনৈতিক মানচিত্র নামে একটি মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল। ৩৭০ ধারা বিলোপের বছরপূর্তির আগেই মানচিত্র প্রকাশ করা হয়। যেখানে জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখের পাশাপাশি পশ্চিম গুজরাটের জুনাগড় শহরটিও পাকিস্তানের অংশ হিসাবে দাবি করা হয়েছিল। ভারতের বিদেশ মন্ত্রক পাকিস্তানের ওই মানচিত্রকে রাজনৈতিক অযৌক্তিকতা বলে উল্লেখ করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিল। বিবৃতিতে লেখা হয়েছিল, ‘পাকিস্তানের এই মানচিত্র হাস্যকর। এর আইনগত বৈধতা বা আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।’
জুনাগড় নিয়ে টানাটানি
তৃতীয় মুহাম্মদ মহাবত খানের নাতি মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর খান একসময় দাবি করেছিলেন, তাঁর দাদু যে পরিমাণ সম্পত্তি ভারতে রেখে গিয়েছিলেন, তার অঙ্ক কোটি কোটি টাকা। তিনি জুনাগড়ে আসতে চেয়েছিলেন। যদিও বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, জুনাগড় থেকে করাচি যাওয়ার পর মহাবত খানই নাকি একসময় ভারতের ফিরতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে জুনাগড়ে ফিরে আসার এবং তাঁর রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে একত্রিত করায় তাঁর আপত্তি নেই বলেও নাকি জানিয়েছিলেন। তবে কোনও ভাবে তা সম্ভব হয়নি। সেই তথ্য মিথ্যা বলেই দাবি করেছিলেন জাহাঙ্গীর খান। ২০২৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। এদিকে মমতাজ জাহরা বালোচের সাম্প্রতিক দাবির পর জুনাগড় শাসনকারী বাবি পরিবারের সদস্য শেহনাজ বাবি বলেছেন, পাকিস্তান “দিবাস্বপ্ন দেখছে”। “তারা যা বলছে তা দিবাস্বপ্নের মতো, এটা কখনই সম্ভব নয়” শেহনাজ আরও বলেন, “জুনাগড় ভারতের একটি অংশ ছিল এবং আগামীতেও থাকবে। কখনই পাকিস্তানের অংশ হতে পারে না।”