সহেলি দত্ত, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ অবশেষে শেষ হতে চলেছে দেড়শো বছরের পথচলা। কলকাতা শহরের অলিগলি থেকে বিদায় নিতে চলেছে কলকাতার গর্ব, কলকাতা ট্রাম। ট্রাম মানেই শহরবাসীর কাছে এক নস্টালজিয়া। পরিবেশ বান্ধব এই ট্রাম বহু মানুষের যাত্রাপথের বিশ্বস্ত সঙ্গী।
কলকাতা ট্রাম কলকাতার শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহণ ব্যবস্থা। একটি দেশের প্রথম এবং একমাত্র পরিষেবা প্রদানকারী ট্রাম। এই ট্রাম পরিষেবা প্রথম চালু হয় ১৮৭৩ সালে। প্রথমে ঘোড়ার সাহায্যে ট্রাম চালান হতো। পরবর্তীকালে ১৯০২ সালে বিদ্যুতের ব্যবহার করা হয়। ১৮৭৩ সালে আর্মেনিয়া ঘাট থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত প্রথম ট্রাম চালু হয়। যাত্রা পথের দৈর্ঘ্য ছিল ৩.৯ কিলোমিটার। কিন্তু সেই সময় যাত্রীর অভাবে এই পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি নামে লন্ডন ভিত্তিক কোম্পানি কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা শুরু করে। একসময় ট্রাম কোম্পানির হাতে ১৭৭টি ট্রাম ও ১০০০টি ঘোড়া ছিল। পরে স্টিম ইঞ্জিন ব্যবহৃত হত ট্রাম চালানোর জন্য। সেই সময় ট্রাম কোম্পানির ১৯ মাইল ট্রাম লাইন ছিল। ১৯০০ সালের শুরুতে ১৪৩৫ এমএম স্ট্যান্ডার্ড গেজের ট্রাম লাইন চালু হয়। ১৯০২ সালে ট্রাম লাইনের বৈদ্যুতিকরণ শুরু হয়। যেটি ছিল এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা। স্বাধীনতার কিছু পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ক্যালকাচা ট্রামওয়েজ কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করে। বর্তমানে এটি ভারতের একমাত্র ট্রাম পরিষেবা।
কলকাতায় ৭টি ট্রাম ডিপো রয়েছে
বেলগাছিয়া , রাজাবাজার, পার্ক স্ট্রিট, গড়িয়াহাট, টালিগঞ্জ, কালিঘাট ও খিদিরপুর।
টার্মিনাল রয়েছে ৯টি
শ্যামবাজার, গালিফ স্ট্রিট, বিধাননগর, বালিগঞ্জ, এসপ্ল্যানেড, বিবাদি বাগ ও হাওড়া ব্রিজ।
তবে কলকাতায় ক্রমবর্ধমান ফ্রাইওভার ও রাস্তা উন্নয়নের কারণে কয়েকটি ট্রামরুট এখন বন্ধ করে দেওয়া হলেও অবশিষ্ট রটগুলিকে দ্রুতগতির ট্রাম পরিবহণের উপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে। ২০১৫ সালে কলকাতায় ২৫টি ট্রাম রুট ছিল। কিন্তু এখন মাত্র তিনটি রুটে পরিষেবা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।
পরিবহন দফতর সূত্র অনুযায়ী, অনেকে কাঠামোগত সমস্যার কারণ এবং মেট্রোর কাজের জন্য ট্রাম চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পর থেকে এসপ্ল্যানেড-খিদিরপুর রুটও বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে কলকাতার দুটি রুটে ট্রাম চলত। একটি ছিল বালিগঞ্জ-ধর্মতলা, অপরটি শ্যামবাজার-ধর্মতলা রুট। এই দুই রুটেও বন্ধ করা হবে যাত্রী পরিষেবা। আগের তুলনায় কলকাতায় জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কলকাতার রাস্তায় মাত্র ৬ শতাংশ জায়গা গাড়ির জন্য উপলব্ধ, যা মুম্বই ও দিল্লির তুলনায় অনেক কম। এসমস্ত একাধিক কারণেই ট্রাম পরিষেবা সীমাবদ্ধ করা হচ্ছে। এই কারণে কলকাতায় ট্রামের ঐতিহ্যবাহী সংযোগ শুধুমাত্র ময়দান এবং এসপ্ল্যানেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে ঘোষণা করেছেন পরিবহণ মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী। এরপর রাজ্য সরকার তরফে একটি বিবৃতির মাধ্যমে জানান হয়, শহরের ট্রাম রুটগুলির বেশিরভাগই বাতিল করা হবে, শুধুমাত্র ঐতিহ্যবাহী রুটটি পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য চালু থাকবে। একসময় কলকাতার বুকে কান পাতলে শোনা যেত তাঁদের চাকার শব্দ। ট্রাম নিয়ে জনস্বার্থ মামলা চলছে হাইকোর্টে।
উল্লেখ্য কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে পুলিশের তরফে জানান হয়েছিল, ট্রাম অত্যন্ত ধীর গতিতে চলে। ফলে ট্রাফিকের সমস্যা হয়। ফলে এই ট্রাম তুলে দেওয়ার পক্ষ তাঁরা। তবে তাঁর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি সাফ জানিয়েছিলেন, পুলিশের একার কথায় রাজ্যের এতবড় একটি হেরিটেজের তকমা পাওয়া ঐতিহ্যবাহী জিনিসকে নষ্ট করা যায় না। বরং যে পরিমাণ ট্রাম চলছে, তা আরও আধুনিক ও আকর্ষণীয় করার পরিকল্পনা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন পরিবহণ দফতরকে। কিন্তু পরিবহণ দফতর থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, তারা রাজ্য থেকে ট্রাম তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে জানাবে।খালি পর্যটকদের জন্য ধর্মতলা থেকে ময়দান পর্যন্ত জয় রাইড থাকবে। বর্তমান পরিচালন সংস্থা নানা কারণ দেখিয়ে ট্রাম পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করলেও জনসচেতনতা ও আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে কলকাতার ট্রাম ব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য চেষ্টা করে ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংস্থা।