মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আরজিকরে ধর্ষণ ও খুনকাণ্ডে একমাসেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত। ডাক্তারদের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষজন সুবিচারের দাবিতে পথে নেমেছেন। আট থেকে আশি রাস্তায় নেমে স্লোগান দিয়ে আরজিকরের নির্যাতিতার জন্য সুবিচার চেয়েছেন। হুবহু আরজিকরের মতোই একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছিল কেরালায়। ৩২ বছর পেরোলেও এখনও মেলেনি সুবিচার। আরজিকরের মামলারও এমন পরিণতি হবে না তো ?
২৭ মার্চ ১৯৯২ সালে কেরালার একটি খ্রীষ্টান হস্টেলের নান আরেক অভয়া ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে জল খেতে যান। এর ৬ঘণ্টা পর ওই হস্টেলের কুয়ো থেকে তার দেহ উদ্ধার হয়। আরজিকরে যেভাবে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ উঠছে, এই মামলাতেও প্রমাণ লোপাট করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। আরজিকরের মতোই অকুস্থলে ভাঙচুর করে নির্মাণকাজ করা হয়। প্রথমে মামলাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করে পুলিশ। পুলিশের পাশাপাশি সিবিআইয়ের রিপোর্টেও আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়।
কেরলের রাজধানী কোচি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে কোট্টায়াম জেলায় সেন্ট পিটার্স স্ট্রেন্থ কনভেন্ট নামে একটি স্কুল আছে। সেই স্কুলের গার্লস হস্টেলে অভয়া পড়াশোনা করতেন। পরে নান হওয়ার জন্য কনভেন্ট স্কুলে আসেন তিনি। ১৯৯২ সালে ২১ বছর বয়স ছিল মেয়েটির। সেসময় দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন অভয়া। মার্চে দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড এক্সামের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। ২৭ মার্চ ঘুম থেকে উঠে জল খাওয়ার জন্য হস্টেলের রান্নাঘরের দিকে যান। কিন্তু কেউ তাঁকে রান্নাঘর থেকে ফিরতে দেখেননি। সকাল হতেই দেখা যায় রান্নাঘরে ফ্রিজের দরজা হাট করে খোলা। আর নীচে খোলা অবস্থায় পড়ে আছে জলের বোতল। পাশে একটি জুতো পড়ে ছিল। হস্টেলের বাইরে আরেকটি জুতো পাওয়া যায়। রান্নাঘরের কাছে একটি কুড়ুলও পাওয়া গিয়েছিল। জুতোটি চিনতে পারেন হস্টেলেক আবাসিকরা। কয়েকজনের সন্দেহ হয়। চারদিকে খুঁজেও অভয়ার সন্ধান মেলেনি। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। হস্টেলের কুয়ো থেকে ওই নানের দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর কাঁধে এবং মাথায় দাগও পাওয়া যায়। এর থেকেই স্পষ্ট যে এটি কোনও আত্মহত্যার ঘটনা নয়।
শুরুর দিকে এই মামলার তদন্ত করছিলেন কেরল পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর ভিভি অগাস্টিন। একজন স্থানীয় ফটোগ্রাফারকে ডেকে দেহের ছবি নেওয়া হয়। অভয়ার ঘাড় সহ একাধিক জায়গায় নখের দাগ ও বিভিন্ন ক্ষতের দাগ ভালোভাবেই তুলেছিলেন ওই ফটোগ্রাফার। সাব ইনস্পেক্টর মৃতার পোশাক, রান্নাঘর থেকে উদ্ধার হওয়া জিনিসপত্রের তালিকা বানিয়েছিলেন। বোতল, জুতো, কুড়ুলের মতো জিনিসপত্রের নাম লেখা ওই তালিকায়। তারপর দেহটি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মৃতার ময়নাতদন্ত করেন ডাক্তার রাধাকৃষ্ণন। তিনি রিপোর্টে কখনও মৃতার শরীরে থাকা নখের দাগের কথা উল্লেখই করেননি। জলে ডুবে মৃত্যুর কথা ময়নাতদন্তের রিপোর্টে লিখেছিলেন তিনি। তদন্তকারী আধিকারিক ইনস্পেক্টর ভিভি অগাস্টিন প্রাথমিক রিপোর্টে লিখেছিলেন এটি আত্মহত্যাও হতে পারে আবার খুনও হতে পারে। তদন্ত শুরুর মাত্র দুদিনের মধ্যে ইনস্পেক্টর ভিভি অগাস্টিনকে তদন্ত থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। যে পোশাক এবং সিজার লিস্ট তিনি বানিয়েছিলেন, তাও উধাও হয়ে যায়। মৃতাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কিনা, তা জানতে মৃতার যোনী থেকে কিছু স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়। সেই রিপোর্টেও হোয়াইটনার ব্যবহার করে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ। এমনকি সিমেন ডিটেকটেড কথাটিকেও নট ডিটেক্টেড করা হয়।
সাংবাদিক সৃজন বালকৃষ্ণন এই রিপোর্টটি প্রকাশ্যে এনেছিলেন। প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার বিষয়টিকে সামনে এনে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন কেরালার ওই মামলায় কি নানকে ধর্ষণ রে খুন করা হয়েছে ? মেডিক্যাল রিপোর্টে জাল সই করার কারণে এটি অবৈধ হয়ে যায় বলে খবর। আরজিকরকাণ্ডে ময়নাতদন্তের যে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল, তাতেও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল।
কেরালার ওই মামলায় স্থানীয় বাসিন্দারাও পুলিশের উপর চাপ তৈরি করতে থাকে। স্থানীয় থানার থেকে স্পেশাল ক্রাইন ব্রাঞ্চে পাঠানো হয় মামলা। সেখান থেকে বলা হয়, মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। সিস্টার অভয়া মানসিক রোগী ছিলেন বলে জানানো হয়। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ রাধাকৃষ্ণন জানান, ক্রাইম সিন ভিজিট করতে চাইলেও তাঁকে ভিজিট করতে দেয়নি কেরল পুলিশ। এখানেই শেষ নয় অকুস্থলে নির্মাণকাজ শুরু করে দেওয়া হয়, যাতে সেখানে কোনও প্রমাণ অবশিষ্ট না থাকে। আরজিকরেও এমনই ছবি দেখা গিয়েছে , ক্রাইম সিনে একাধিক মানুষের ঢুকে পড়া, রেস্টরুম তৈরির নামে নির্মাণকাজের মতো ঘটনা দেখা গিয়েছে।
আরজিকরের মতো কেরালার এই মামলায় রাস্তায় নেমেছিলেন বহু মানুষ। মৃতা নানের বন্ধু এবং পরিজনরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পিটিশন জমা দেন। মামলা যায় সিবিআইয়ের হাতে। একবছর পর মামলার তদন্ত শুরু করে সিবিআই। সকলে ভেবেছিলেন এবার সুবিচার মিলবে। তদন্ত শুরু করেছিলেন ভার্গিস পিথোমাস। তিনি রিপোর্টে অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে দাবি করেন। কয়েকমাসের মধ্যেই তাঁকে অন্য মামলার তদন্তের জন্য সরিয়ে দেয় সিবিআই। ৯ মাসের মাথায় ইস্তফা দেন তিনি। প্রায় ৭বছরের চাকরি বাকি ছিল বলেও জানিয়েছিলেন ভার্গিস। সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে ভার্গিস জানান, মামলাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর জন্য সিনিয়ার অফিসার থ্যাগারাজন চাপসৃষ্টি করছিলেন তাঁর উপর। তারপরই সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় ওঠে। সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সিবিআইয়ের সিনিয়র অফিসার থ্যাগারাজনকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। সিবিআইয়ের অফিসের সামনে আন্দোলন করেন সাধারণ মানুষ । এতকিছুর পরও ১৯৯৬ সালে ফাইনাল রিপোর্ট জমা করে মামলাটিকে আত্মহত্যা বলে জানায় সিবিআই। আদালতে কেস ক্লোজ করার আবেদন জানায় তারা। সেই আবেদন খারিজ করে নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় রিপোর্ট জমা দেয় সিবিআই। তাতে মামলাটিকে খুন বলে জানায় সিবিআই। কিন্তু খুনিকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না বলে কেসটি বন্ধ করার আবেদন জানায় সিবিআই। সেই আবেদন খারিজ করে আদালত। ভালোভাবে তদন্ত করে খুনিকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেয় আদালত। কেরালা হাইকোর্ট একটি স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করে দিল্লির সিবিআই দফতরে একটি নতুন টিম পাঠায়। ২০০৫ সালে তৃতীয় রিপোর্ট দেয় সিবিআই। তাতে জানানো হয় মামলাটি খুন নয় আত্মহত্যা। এতদিনে অভয়ার মৃত্যুর ১৩বছর কেটে গিয়েছে। তারপরও মৃত্যু না আত্মহত্যা জানা যায়নি। যে রাতে তরুণীর মৃত্যু হয়েছিল। হস্টেলের ছাদ থেকে তামার তার চুরি করতে গিয়েছিলেন রাজু নামে এক ব্যক্তি। সেময়ে হস্টেলে ওই চার্চের ফাদার থমাস কুট্টুরকে দেখা গিয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন রাজু। চুরি করা তার ভাঙাচোরার দোকানদার সামির নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন তিনি। ফাদার কুট্টুরকে দেখার বিষয়টি পুলিশকে জানানো নিয়ে দোটানায় ছিলেন রাজু। কারণ চুরির বিষয়টি বললে তিনি জেলে যাবেন। এক সপ্তাহ পর মনে সাহস জুগিয়ে পুলিশের কাছে যান রাজু। ফাদার কুট্টুরকে দেখার বিষয়টিও পুলিশকে জানান তিনি। কিন্তু পুলিশ রাজুর পাশাপাশি ভাঙাচোরার দোকানদার সামির ও তার ভাইকেও জেলে ঢুকিয়ে দেয়। টানা ৭দিন ধরে রাজুর উপর অত্যাচার চালায় পুলিশ। রাজু খুন করেছে বলে স্বীকার করার জন্য চাপসৃষ্টি করা হয়। একাধিক প্রলোভন দেখিয়ে সামির ও তার ভাইকে রাজুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার কথাও বলা হয়। কিন্তু তাতে রাজি হয়নি তারা। অবশেষে তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ। কিন্তু এদের কারোর কথাই আদালতে জানায়নি পুলিশ।
২০০৫ সালে আদালতের চাপে ৩জনকে গ্রেফতার করে সিবিআই। ফাদার কুট্টুর, ফাদার পুথ্রিক্কায়াল এবং সিস্টার সেফিকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃতরা কেউই একথা স্বীকার করতে চায়নি। তারপর তাদের নার্কো টেস্ট করা হয়। তাতেই উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বহুদিন ধরে ফাদার কুট্টুর এবং সিস্টার সেফির মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক ছিল। যা সকলের কাছে লুকিয়ে আসছিলেন তাঁরা। কারণ খ্রীষ্টান ধর্মে ফাদার এবং সিস্টারদের এধরণের সম্পর্কে জড়ানো পাপ বলে গণ্য করা হয়। ফাদার কুট্টুর প্রায়ই স্টেফির সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। তার সঙ্গে ছিলেন ফাদার জোসেফ। অভয়া ভোরবেলায় উঠে যখন জল খেতে গিয়েছিলেন, তখন ওই তিনজনকে অস্বস্তিকর অবস্থায় দেখেন। তারপরই কুট্টুর মেয়েটির গলা চেপে ধরে। আর সেফি কুড়ুল দিয়ে মেয়েটির মাথায় আঘাত করে। তার দেহটি কুয়োতে ফেলে দেয় তারা। নার্কো টেস্টের রিপোর্ট যখন আদালতে পৌঁছয় তখন একাধিক জায়গায় স্বীকারোক্তিগুলো গায়েব করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। একাধিক জায়গায় এডিট করা হয়েছে বলে জানা যায়। সিলড প্যাকেজে অরিজিনাল ফুটেজ জমা করার নির্দেশ দেয় আদালত। বেঙ্গালুরুর ডাক্তার মালিনীর তত্ত্বাবধানে এই নার্কো টেস্ট হয়েছিল। সেই ডাক্তার মালিনীকে আদালতে হাজিরার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তার আগেই মালিনীকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করা হয়। কারণ নাকি চাকরিতে ঢোকার সময় তিনি জাল বার্থ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন।
এরইমধ্যে সিস্টার সেফির ভার্জিনিটি টেস্ট করে সিবিআই। নিয়মিত শারীরিক মিলন করেন কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য এই টেস্ট করা হয়। তখনও ফের চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে সিবিআইয়ের হাতে, সিস্টার সেফি নিজেকে ভার্জিন প্রমাণ করার জন্য হাইমেন সার্জারি করিয়েছিলেন তাও আবার অভয়ার মৃত্যুর পরের দিন। ওই হস্টেলেরই চার্চ হসপিটাল থেকেই সার্জারি করিয়েছিলেন সেফি। যদিও ২০২৩ সালে দিল্লি হাইকোর্ট ভার্জিনিটি টেস্টকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। কারণ এই টেস্ট মানুষের গোপনীয়তাকে লঙ্ঘন করে। অভয়ার মৃত্যুর পরই সিস্টার সেফির হাইমেন সার্জারি তাকে সন্দেহের তালিকায় ফেলে দেয়। এরইমধ্যে মামলার প্রথম তদন্তকারী ভিভি অগাস্টিনের দেহ উদ্ধার হয়। আত্মহত্যা করেন তিনি। একটি সুইসাইড নোটে অগাস্টিন লিখেছিলেন সিবিআই অফিসাররা তাঁর পর মানসিক চাপসৃষ্টি করছেন। সিস্টার অভয়ার মৃত্যুর ২৮বছর পর ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর তিরুবনন্দপুরমে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত ফাদার কুট্টুর ও সিস্টার সেফিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫ লক্ষ টাকা জরিমানার নির্দেশ দেয়। ফাদার জোসেফকে ছেড়ে দেয় আদালত। তার ৪বছর আগেই মৃত্যু হয়েছিল অভয়ার মা-বাবার। ২০২২সালে এদের শাস্তি বাতিল করে দেয় কেরালা হাইকোর্ট। অভয়ার হত্যার ৩২বছর পরও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে খুনিরা।
আরজিকরকাণ্ডেও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু আমজনতা যেভাবে প্রতিবাদের পথে হেঁটেছে, তাতে বেশ খানিকটা এগিয়েছে মামলার তদন্ত। কলকাতা পুলিশ হোক বা সিবিআই, কলকাতা হাইকোর্ট হোক সুপ্রিমকোর্ট মামলা যেখানেই থাকুক না কেন, প্রতিবাদের আঁচ যাতে না থামে। কেরালার এই মামলার মতো যেন আরজিকরের পরিণতি না হয়, তার জন্য প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে।