সহেলি দত্ত, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ১৯৫৯ সালে নেহেরু লোকসভায় বলেছিলেন, ভূটানের উপর আক্রমণ করা মানে ভারতের উপর আক্রমণ। এখন থেকে ভূটানের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব ভারত সরকারের। এরপর থেকে প্রতিবেশী দেশ ভূটানের সঙ্গে ভারত সবসময়ই এক বিশেষ সম্পর্ক রেখে চলেছে।
২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে ভারত ভূটানকে প্রায় ৬১.৬ বিলিয়ন রুপি অর্থ সহায়তা দিয়েছিল। যা ভারতের বৈদেশিক সহায়তা বাজেটের সর্বোচ্চ অনুদান। এছাড়া ভারতের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ভূটানে ১৪১৬ মেগাওয়াটের তিনটি হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্ট চালু রয়েছে এবং ২১২৯ মেগাওয়াটের আরও তিনটি হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের কাজও চলছে। তবে এটাই প্রথম নয়। ভূটানের প্রতি ভারতের এই উদার নীতি চলে আসছে অনেক আগে থেকেই। ভূটানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী বাজেটের সম্পূর্ণ অর্থায়নই ছিল ভারতের অনুদান। যার পরিমাণ ছিল ১৩ মিলিয়ন ডলার। ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভূটান ভারত থেকে সর্বমোট ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা পেয়েছে যা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বড় অনুদান।তবে এখন প্রশ্ন ভারত ভূটানের অর্থনীতিতে কেন এতটা অবদান রাখছে।
ভৌগোলিকভাবে ভূটান মাত্র দুটি দেশের সঙ্গে সীমানা শেয়ার করে। উত্তরে চিনের তিব্বত অঞ্চল, পশ্চিমে সিকিম তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা, পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ এবং দক্ষিণে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ। ভূটানের এই অবস্থানই ভারতের কাছে ভূটানকে এতো গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। তবে এতে দু দেশের লাভ ঠিক কতটা হয় তা অনেকেরই অজানা। ভূটানের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য কোনও সমুদ্র সীমানা না থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য ভূটানের ভারত নয় চিনের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। তবে একাধিক কারণে চিনের সঙ্গে ভূটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় ১৯৭০ সালে ভূটান তিব্বতীয় অঞ্চলের সীমান্তও বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ শক্তিশালী প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও চিন যেন একটা মস্ত দেওয়ালের মতো ভূটানের একটি দিক বন্ধ করে রেখেছে। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে ১৯৪৯ সালের ৯ অগাস্ট ভারত ও ভূটানের মধ্যে সর্ব প্রথম একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু যেহেতু ভারত ভূটানের একমাত্র সীমানা বেষ্টিত প্রতিবেশী যার সঙ্গে ভূটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে তাই শুরু থেকেই ভূটানের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক সম্পর্কে সহযোগিতার নামে প্রভাব রাখতে শুরু করে ভারত। ভারত ভূটানের এই সম্পর্ককে ভারতের আধিপত্যের উদাহরণ বলেও মনে করেন অনেকে।ভারত ও ভূটানের সম্পর্ক অনেকটাই এই রকম। বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছে ভারতের এই উদারনীতি ভূটানকে নিজেদের হাতে রাখার একটি মোক্ষম অস্ত্র। এই সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য, ভারত কখনই চায় না চিনের সঙ্গে ভূটানের কোনরকম কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হোক।
ভারতের অন্যতম বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অব বোড়োল্যান্ড ভারতের অভ্য়ন্তরীণ রাজনীতিতে বড় ধরনের হুমকি। এই দুইটি সংগঠনের বেশ কিছু ক্যাম্প ভূটানে। ভারত বরাবরই ভূটানকে এই দুটি সংগঠনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে চাপ দিয়ে আসছিল। শুরুতে ভূটান বিষয়টি খুব একটা গায়ে না মাখালেও ভারতের চাপের মুখে ২০০৩ সালে ৬০০০ সেনা সদস্যের একটি বিশাল দল নিয়ে সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালায়। যার নাম ছিল অপারেশন অল ক্লিয়ার। আবার ভূটান ভারতের আমদানি খাতের অন্যতম বড় উৎস। ২০২২ সালে ভারত ভূটান থেকে প্রায় ৩৪৩.১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। যার মধ্যে ছিল বিদ্যুৎ, ডলোমাইট, জিপ্সা, লৌহ জাতীয় পণ্য ইত্যাদি। অর্থাৎ ভারত ভূটানের রপ্তানি খাতে সবথেকে বড় গ্রাহক। শুধু অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক বিষয়েই নয় ভূটানের অভ্যন্তরীণ বিষয় সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে সরকার গঠনে ভারতের ভূমিকা খুবই স্পষ্ট। সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে শুরু করে অস্ত্র সরবরাহ সবকিছুতেই ভূটান ভরতের উপর নির্ভরশীল। ভূটানের সেনাবাহিনীতে যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয় তার সবটাই ভারত থেকে আমদানি করা । অন্যদিকে ভূটানের আকাশ সীমানায় সুরক্ষার দায়িত্বে কাজ করছে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিমান বাহিনী। আবার ভূটানের অভ্য়ন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয়টি সবসময়ই সামনে এসেছে । ভারত কখনোই চায়নি ভূটানে চিন বান্ধব কোনও সরকার ক্ষমতায় আসুক। ২০১৩ সালের নির্বাচন এর সবথেকে বড় প্রমাণ। নির্বাচনের প্রথম অংশে একটি বড় ব্যবধানে তৎকালীন চিনপন্থী সরকারি দল এগিয়ে ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই ভারত ভূটানে গ্যাস , কেরোসিন রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে ভূটান থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের উপর ভর্তুকি মূল্য বাতিল করে দেয়। এর ফলে খুব নাটকীয়ভাবে নির্বাচনের পরবর্তী ধাপে তৎকালীন বিরোধী দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি বা পিডিপি জয় লাভ করে। পিডিপির এই জয়কে ভারতের স্বস্তির নিঃশ্বাস বলে আখ্যায়িত করা হয়। এরপর পূর্ববর্তী সকল পদক্ষেপ বাতিল করে আবারও ভারত ভূটানের সম্পর্ক আগের নিয়ম চলবে বলে ঘোষণা করা হয়। বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রেও ভূটানের উপর ভারতের অভিভাবক সুলভ আচরণ ছিল চোখে পড়ার মতো। কারণ ভূটানের পররাষ্ট্রনীতি সরাসরি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অন্য কোনও দেশর সঙ্গে ভূটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ভারতের অনুমতি নিতে হয়। এমনকি জাতি সংঘের প্রধান পাঁচটি দেশের সঙ্গে ভূটানের এখনও কোন ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়নি। ২০০৭ সালে ভারত ভূটানের মধ্যেকার চু্ক্তিটি আবারও নতুনভাবে স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে বলা হয়, এখন থেকে ভূটান বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ভারতের মুখাপেক্ষি হবে না। কিন্তু সেটি কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তা বড় প্রশ্ন।
ইতিমধ্যে ভূটান চিনের মধ্যেকার সীমানা সমস্যার সমাধান নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে আলোচনা শুরু হলেও ভারতের বাধার মুখে তা বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু চিন বরাবরই চেষ্টা করছে ভূটানের সঙ্গে সকল সমস্যা সমাধান করতে। কারণ চিনের কাছে এখন ভূটান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-খণ্ড হিসেবে বিবেচিত। সম্প্রতি বেইজিং এবং থিম্পুর মধ্যে বেশ কিছু চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। যার ফলে ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করে। কারণ ভূটানের সঙ্গে যদি চিনের সম্পর্ক ভালো হয়। তবে দেশটির উপর থেকে ভারত তার একছত্র আধিপত্য হারাবে। শুধু অর্থনৈতিক নয় ভৌগোলিক ও কূটনৈতিকভাবে ভারত বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হবে। যদি ভূটান শেষ পর্যন্ত চিনের বলয়ে চলে যায় , তবে তা ভারতের জন্য একটি বড়ো হুমকি হবে। শুরু থেকেই ভূটানের প্রতি ভারতের এমন বিশেষ সম্পর্কের পিছনে ভৌগোলিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণগুলি ভূমিকা রেখেছে। যার জেরে কৌশলগতভাবে ভারত বিভিন্ন সামরিক, প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অবদান রেখেছে। তবে এখন দেখার এই দুই দেশের মধ্যে আর কতদিন এই বিশেষ সম্পর্ক বজায় থাকে। ভূটান যে ভারতের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে তা এখন ক্রমশ স্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে ভারতের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।