সহেলী দত্ত, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ গাজায় ইজরায়েলি নারকীয়তায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৪২ হাজার মানুষ। যার প্রায় অর্ধেকই শিশু। বোমা ফেলে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গোটা এলাকা। গাজা যেন আজ এক মৃত্যু পুরী। ইজরায়েলের বর্বরতা এখানেই থেমে থাকেনি। সম্প্রতি হিজবুল্লাহকে দমনের নামে চড়াও হয়েছে লেবাননে। শুধুমাত্র কয়েক সপ্তাহের হামলায় প্রাণ কেড়ে নিয়েছে হাজার খানেক মানুষের। বিমান হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না স্কুল, হাসপাতাল মসজিদও। ইজরায়েল বর্ববর আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ। আরব বিশ্বের ব্যর্থতার জন্য আজ ফিলিস্তিনিদের এই দুর্দশা। তবে সেই আরব বিশ্ব আজ কতটা সরব … মাস চারেক আগে রাফা শরণার্থী শিবিরে ইজরায়েলে ভয়াবহ হামলার পর সৌদি আরব এক বিবৃতি দিয়েছিল। ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব ইজরায়েলকে মেনে নিতে হবে এমন এক বিবৃতি দিয়ে দায় সেরেছিল দেশটি। লেবাননে ইজরায়েলে ধ্বংসলীলা শুরু হওয়ার পর একটি বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগের কথাই শুধু জানিয়েছিল দেশটি। তবে সৌদি আরব শুধু নিরব দর্শকের ভূমিকাই নিত যদি না তারা নিজেদের ভাবমূর্তির বিষয়টি ভাবত। একদিকে মুসলিম দেশ গুলির সংগঠন। অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কর্পোরেশনের সদর দফতর রয়েছে সৌদি আরবে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মুসলিম হজ পালনের জন্য সেখানে যান। যে কারণে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বব্যাপী নিজেদের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে ফিলিস্তিনিদের লড়াই থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না দেশটি। তবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যদেশগুলি ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়া নিয়ে মাথা ঘামায়নি। হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরুল্লাহকে হত্যার পর গাজা ও লেবাননকে ঘিরে যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এই বিষয়ে সংযুক্ত আরব আমিরা একেবারে নিশ্চুপ। মুখে কুলুপ এটেছে কাতার ও বাহারিনও। মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তা আল সিসি বলেছিলেন যেকোনো মূল্যে ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে কার্যত কোনও উদ্যোগই নিতে দেখা যায়নি মিশরকে। এদিকে জর্ডানকে ইজরায়েলের দিকে ছোড়া ইরানের মিসাইল ভূপতিত করতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। গত এপ্রিলেও ইজরাইলকে ইরানের ড্রোন ও মিসাইল থেকে বাঁচানোর জন্য আমেরিকা আর ব্রিটেনের পাশপাশি জর্ডানও ছিল দারুণ উৎসাহী। তবে ইজরায়েলের এই বর্বর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কেন সোচ্চার হচ্ছে না আরবের দেশগুলো। তার কারণ হিসেবে দেখতে গেলে ফিরে যেতে হবে অতীতে। ইতিহাস বলে প্রাথমিকভাবে ইসলামিক বিজয়ের সময়কাল শুরু হয় সপ্তম শতাব্দীতে। এই শতাব্দীর মাঝামাঝিতে উমাইয়া খেলাফত পর্তুগাল থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত ইসলামিক সাম্রাজ্য বিস্তার করে। তৎকালীন বাইজেন্টাইন শাসিত অঞ্চল অধিগ্রহণের মাধ্যমে বিপুল ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় উমাইয়া খেলাফতের শাসনে আসে। ৮৯ বছর ধরে তারা শাসন করে বিশাল ইসলামি সাম্রাজ্যকে। ইতিহাস অনুযায়ী এক পর্যায়ে উমাইয়া খেলাফতের অবসান ঘটে আব্বাসীয় বংশের হাতে। এই উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খেলাফতের শাসন আমলে বাগদাদ, দামাস্কাস এবং কায়রো শিক্ষা দীক্ষার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিমরা ছাড়িয়ে যায় পশ্চিমাদের। অর্থাৎ খিলাফতের ওই সময়কাল ছিল আরব বিশ্বযুগের স্বর্ণযুগ। এমনকি ১৬ শতকে উসমানীয়দের একচ্ছত্র আধিপত্য আরবদের জাতীয় ঐক্যকে দমাতে পারেনি। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সূর্ষ সীমিত হতে থাকে। আরব বিশ্বে প্রবেশ করে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের মতো অভিনব ইউরোপীয় ধারণাসমূহ। এসময় আরব মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে। ইউরোপায় ধারণার সঙ্গে ইসলামিক সংহতিকে একত্রিত করতে নাহুদা তথা আরব জাগরণের মত বিপ্লব সংগঠিত হয়। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন হলে আরব বিশ্বকে টুকরো টুকরো করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় ব্রিটেন ও ফ্রান্স। আর সমস্যার সূত্রপাত হয় এখান থেকেই। মূলত ব্রিটেন ও ফ্রান্স মিলে আরব বিশ্বকে যেভাবে ভাগ করেছিল সেই এখানে দেশগুলোর সীমানা টানা হয়েছিল ইচ্ছেমতো। সুতরাং আরবদের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া সীমানা বিভক্তি আর বিভাজনী তৈরি করেছে কেবল। এই বিভক্তির প্রমাণ মেলে প্রথম আরব ইজরায়েলের যুদ্ধে। তবে ইজরায়েলকে প্রতিরোধের বদলে ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের দিকে বেশি মনোযোগ ছিল আরব নেতাদের কারণ ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পুরস্কার হিসেবে মিশর গাজার ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার অংশ দখলের সুযোগ পায়। সেখানে তারা সামরিক উপনিবেশ স্থাপন করে। পরে যদিও ইজরায়েল সেগুলি দখল করে নেয়। এরপর আরবদের সঙ্গে ইজরায়েলের আরও পাঁচটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর মূল কারণ আর ফিলিস্তিন ছিল না। যেমন ১৯৫৬ সালের যুদ্ধটি হয়েছিল সুয়েজ খালকে ঘিরে। ১৯৬৬ সালের যুদ্ধ হয়েছিল ইজরায়েলের সম্প্রসারণের কারণে। তবে প্রতিবারই ইজরায়েলের কাছে লজ্জার পরাজয় বরণ করতে হয়েছে আরবদের। যে কারণে ফিলিস্তিনি ইস্যু ধামাচাপা পড়ে যায় আরব দেশগুলোর নিজস্ব স্বার্থ বাঁচাতে গিয়ে। শুধুমাত্র স্বার্থ রক্ষার জন্যই ইজরায়েলকে দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতিও দেয়। জর্ডান এবং মিশর প্রথমে মিশর ইজরায়েল শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয় ১৯৭৯ সালে। এরপর জর্ডান ইসরায়েল শান্তি চুক্তি হয় ১৯৯৪ সালে। এরপর ২০২০ সালে ইব্রাহাম একর্ডে স্বাক্ষর করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহারিন ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিয়েছে। পরে সুদান ও মরক্কো যোগ দেয় ওই দলে। যে কারণে ফিলিস্তিন ইস্যু বা গাজা ইজরায়েল চালানো গণহত্যার বিষয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না এই দেশগুলোকে। তবে আরবদের মধ্যে সংহতির একটা আভাস কিন্তু মিলেছিল ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝিতে। তবে আরবরা একটি রাষ্ট্রবিহীন জাতি হিসেবে স্বদেশের অনুসন্ধান করতে গিয়ে একত্রিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ক্রমাগত ব্যর্থতায় ২২টি আলাদা আলাদা দেশে বিভক্ত হয়ে এখন আরবরা জাতিবিহীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।