মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ২৬ বছরের চ্যাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অ্যানা সিবাস্টিয়ান পেরিয়াল পুনের আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং গ্লোবালে কর্মরত ছিলেন। জুলাইতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় অ্যানার। তাঁর মা অনিতা অগাস্টিন ইভা ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর মেয়েকে অফিসে ব্যাপক মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কাজের চাপে একাধিক রাত জাগতে হয়েছে। এর জেরে জুলাই মাসে মৃত্যু হয় অ্যানার। চিঠিতে অ্যানার মা অনিতা অগাস্টিন লিখেছেন, ছোট থেকেই লড়াকু মেয়ে অ্যানা। স্কুল টপার, কলেজ টপার। এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসেও এগিয়ে ছিল অ্যানা। সিএ পরীক্ষায় পাশ করে ই-ওয়াই সংস্থায় কাজে যোগ দেন অ্যানা। কাজের পরিবেশ এবং দীর্ঘসময় ধরে চলা কাজের ফলে তার উপর মানসিক চাপ পড়ে। কয়েকদিন আগে বুকে ব্যথার কারণে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় অ্যানাকে। দেরি করে খাও য়া এবং পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে অ্যানার এই অসুস্থতা বলে জানান চিকিৎসক। ৬ জুলাই কলেজের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের জন্য নিজের বেতনের টাকা খরচ করে তাঁর মা-বাবাকে কোচি থেকে পুনেতে এনেছিলেন অ্যানা। ইভা ইন্ডিয়ায় যোগ দেওয়ার পর সংস্থার ম্যানেজার অ্যানাকে জানিয়েছিলেন, বেশ কয়েকজন কর্মী কাজের চাপে চাকরি ছেড়েছেন। সংস্থার এই ছবিটাই পাল্টাতে হবে বলে অ্যানাকে জানান ম্যানেজার। রাতের পর রাত জেগে, এমনকি ছুটির দিনেও কাজ করেছেন অ্যানা। যে অ্যানা কাজ করতে গিয়ে নিজের প্রাণ দিলেন, তাঁর শেষকৃত্যেও সংস্থার কেউ আসেননি বলে জানিয়েছেন প্রয়াত অ্যানার মা। অ্য়ানার মতো পরিণতি যাতে আর কারোর না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া উচিৎ সংস্থার। নিজের সংস্থার কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অ্যানার মা।
একাধিক সমীক্ষার স্পষ্ট লক্ষ লক্ষ কর্পোরেট কর্মী এমনই পরিণতির দিকে এগোচ্ছেন। ২০২২-এর এপ্রিলে একটি সমীক্ষা করেছিল ম্যাকেন্সি হেলথ ইনস্টিটিউট। ১৫ হাজার কর্মী এবং ১ হাজার এইচআর ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চিন সহ এশিয়ার একাধিক দেশের কর্মীদের মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়। তাতে দেখা গিয়েছে ৪০শতাংশ ভারতীয় কর্মী মানসিক যন্ত্রণা, বিষন্নতা এবং উদ্বেগে ভুগছেন। এর পিছনে ৯০ শতাংশের মানসিক অসুস্থতার কারণ বিষাক্ত কাজের সংস্কৃতি বা টক্সিক ওয়ার্ক কালচার। এর ফলে অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতীয় কর্মীদের মধ্যে চাকরি ছাড়ার ইচ্ছা ৬০শতাংশ বেশি। কিন্তু দেশে হু হু করে বেকারত্ব বাড়ছে দেশে। এই পরিস্থিতিতে এই টক্সিক কালচারের ফলে কতটা বিপদে পড়ছে যুব সম্প্রদায় ?
২৬ বছরের অ্যানা সিবাস্টিয়ান পেরিয়ালের মৃত্যুকে অনেকেই আত্মহত্যা বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু একটি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে অ্যানার মা জানিয়েছিলেন, ২০ জুলাই সন্ধেয় দেরি করে ঘরে ফিরেছিলেন অ্যানা। তারপরই মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই মৃত্যু হয়েছিল অ্যানার। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। অ্যানার বাবা জানিয়েছিলেন , মাত্র ৪ মাস আগে এই কোম্পানিতে কাজে যোগ দিয়েছিলেন অ্যানা। ইভা ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান রাজীব মেমানি জানিয়েছিলেন খুবই দুঃখজনক। সংস্থায় ১ লক্ষ কর্মী রয়েছে। অ্যানা মাত্র ৪মাস আগে যোগ দিয়েছিলেন। অন্যান্যদের মতোই কাজ করতেন অ্যানা। কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধীও এই ইস্যুতে মৃতার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। সরকার চাইলে এই টক্সিক কালচারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে পারে। ঠিক যেমন অস্ট্রেলিয়ার সরকার পদক্ষেপ করেছে। লক্ষাধিক কর্মীকে রাইট টু ডিসকানেক্টের অধিকার দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সরকার। অস্ট্রেলিয়ার কোনও কর্মী অফিসে না থাকলে, এমপ্লয়ার তাঁকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে, সেই কল বা মেসেজ এড়িয়ে যেতে পারবেন ওই কর্মী।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের আইন অনুযায়ী, ওভারটাইম মিলিয়ে সারা সপ্তাহ ৪৮ঘণ্টা কাজ করতে পারেন কর্মীরা। কোনও কাজে কোনও কর্মীদের ৪৮ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। সেইদিক থেকে দেখলে ভারতের ছবিটা একেবারে আলাদা। ভারতের শ্রম দফতরের প্রস্তাব অনুযায়ী, একদিনে একজন কর্মীকে ১২ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করাতে পারে কোম্পানিগুলি। অর্থাৎ এক সপ্তাহে ৫দিন কাজ করলে মোট ৬০ঘণ্টা কাজ করানো যেতে পারে। এর প্রতিবাদে মানুষজন সরব হতেই, নড়েচড়ে বসে কেন্দ্র।
শ্রম দফতরের প্রতিমন্ত্রী শোভা কারান্দলাজে এক্স হ্যান্ডেলে জানান, অসুরক্ষিত এবং শোষনমূলক কর্মসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। কিন্তু তদন্ত হলে কী এর সুরাহা সম্ভব ?
কোম্পানির উপর চাপ পড়লে, খুব বেশি হলে কয়েকজন ম্যানেজারকে বহিস্কার করা হবে। তাতে কি আদৌ কোনও সুরাহা হবে ?
আসলে ওই কোম্পানিগুলিতে যেসব ম্যানেজার থাকেন, তাদেরকেও চাপে রাখেন তাঁদের বস। তাদের উপর উচ্চতর যেসব বস রয়েছেন তাঁরা চাপসৃষ্টি করেন। এই কোম্পানির মালিক অর্থাৎ বড় বড় আরবপতির চিন্তাভাবনাই এই টক্সিক কালচারের জন্য দায়ী। কয়েক মাস আগে ইনফোসিসের কো ফাউন্ডার নারায়ণমূর্তি জানিয়েছিন, ভারতে ওয়ার্ক প্রোডাক্টিভিটি বিশ্বে সবচেয়ে কম। আবেদন করছি, যুব সম্প্রদায় এক সপ্তাহে ৭০ঘণ্টা কাজ করুন।
নারায়ণমূর্তির এই বার্তাকে সমর্থন করেছেন ওলার সিইও ভাবিশ আগরওয়াল। উনি নিজেও নাকি ৭দিনে ২০ঘণ্টা করে কাজ করেন।
বিশ্বে বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্যকর থাকতে তাঁদের ৭ থেকে ৯ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু একটি বিরল জিন রয়েছে, ডিইসি-২। যে জিনের অধিকারীরা কম ঘুমালেও সুস্থভাবেই বেঁচে থাকতে পারেন। বিশ্বে ০.৫শতাংশের শরীরে এই জিন মিলেছে। ২০০৯ সালে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অন মেডিসিনের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যাদের শরীরে এই জিন মিলেছে তাঁরা ৬.২৫ ঘণ্টা ঘুমিয়েও স্বাস্থ্যকর থাকতে পারেন। ওলার সিইও যদি এমনই জিনের অধিকারী হন তাহলে প্রশ্ন ওঠে, তবে কি তিনি খাওয়া, স্নান এবং শৌচকর্ম করতে করতেও কাজ করেন ?
ওলা চালকরা ১০- ১৪ঘণ্টা এমনকি ১৭-১৮ঘণ্টাও কাজ করেন। একজন কর্মীর উপর এতটা চাপ না দিয়ে দুজন কর্মীর মধ্যে ৩৫-৩৫ঘণ্টা কাজ করালে কাজের মান উচ্চতর হবে। এর ফলে দেশে বেকারত্বও কমবে। কম কাজ করলে কাজের মান বাড়বে।
এক্সপার্ট মার্কেট নামক একটি সংস্থা ৪২টি দেশের উপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাদের ওয়ার্ক কালচার এবং জিডিপি পর্যবেক্ষণ করে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে তারা। তাতে দেখা গিয়েছে, তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে লাক্সামবার্গ নামক দেশটি। তারপর রয়েছে আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডের মতো দেশ। এই দেশগুলিতে রবিবার কাজ বন্ধ থাকে। সপ্তাহে ৪০ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয় না। কোয়ালিটি অফ লাইফ এবং হ্যাপিনেস ইনডেক্সের দিক থেকেও এগিয়ে থাকে এই দেশগুলি।
তালিকার সবচেয়ে নিচে রয়েছে মেক্সিকো। যেখানে বেকারত্বের ভয় লেগেই থাকে। শ্রম আইনের কড়াকড়ি নেই। সপ্তাহে ৪৮ঘণ্টা কাজের নিয়ম তেমনভাবে মানেন না সংস্থার মালিকরা। একই ছবি কলাম্বিয়া, চিলি, গ্রিসের মতো দেশে। যেখানে ওয়ার্কিং আওয়ার্স অনেক বেশি।
সবমিলিয়ে কাজের চাপ বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে, সরব হতেই হবে। বসের মুখোমুখি হয়ে কথা বলতে হবে। কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হতে হবে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অন্য সংস্থায় কাজ নিতে হবে। সর্বোপরি নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখুন। তা না হলে, কাজের মানও ক্রমশ নিম্নমুখী হবে। যা সংস্থার পক্ষেও খুব একটা সুখকর হবে না।