পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ হাসিনাকে বিদায় দেওয়া কিংবা বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরানো। সবেতেই যার হাত প্রত্যক্ষভাবে পড়েছে, সেই নামটাই পদ্মাপাড়ের জন্য বর্তমানে বিতর্কের শীর্ষে। নামটা মাহফুজ আলম।
কোটা বিরোধী আন্দোলনের জেরে ৫ অগাস্ট দেশ ছাড়েন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। এরপর থেকে বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে দেশ চালাচ্ছেন শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত মহম্মদ ইউনুস। ইউনুসের নেতৃত্বাধীন জীবনযাপনে অনেকটাই পটপরিবর্তন দেখছে এই নতুন বাংলাদেশ। হিন্দুবিদ্বেষী মনোভাব বারবারই চাপা আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। হাসিনার পতনের পর থেকেই যে এই মনোভাব আরও মাথাচাড়া দিচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে প্রশ্ন হল শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত ইউনুসের আমলে এত অশান্তি কেন ? সেই শান্তি কি তিনি নিজেই চান না, নাকি ইউনুসকে পুতুল করে কলকাঠি নাড়ছেন অন্য কেউ ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে হাসিনার পতনের সময়ে অর্থাৎ কয়েকমাস আগে।
যে আন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছিল, সেই আন্দোলনের মাথা হিসেবে মাহফুজ আলমকে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনুস। এই মাহফুজকে আবার জঙ্গিও বলা হয়েছে। কিন্তু কে এই মাহফুজ আলম? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
যে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সংগঠনের নামে বাংলাদেশে হাসিনাবিরোধী আন্দোলন চলেছে, সেই সংগঠনের লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক ছিলেন মহম্মদ মাহফুজ আলম। সম্প্রতি তাঁকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসের বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। তবে নাহিদ ইসলামদের মতো সামনের সারিতে থাকতেন না মাহফুজ। পিছন থেকে পুরোটা ‘কন্ট্রোল’ করতেন বলে বিভিন্ন মহলের তরফে দাবি করা হয়েছে। ইউনুসের বিশেষ সহকারী মাহফুজকে সচিব পদমর্যাদায় বেতন, আনুষঙ্গিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। জানা যায়, এই মাহফুজ আলম মাদ্রাসা থেকে উঠে এসেছেন।
মাহফুজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৫–১৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তাঁর বাড়ি লক্ষ্মীপুর উপজেলার রামগঞ্জ উপজেলার ইসাপুর গ্রামে। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ‘তাত্ত্বিক নেতা’ হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত ২৮ বছরের মাহফুজ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্রশক্তির নেতারাই ছিলেন শুরু থেকে।মাহফুজকে নিয়ে আগেই সুর চড়ান বাংলাদেশের বিতর্কিত সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন।
ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, “আমি মনে করি বাংলাদেশ চালাচ্ছে একটা ২৮ বছরের ছেলে, তার নাম মাহফুজ আলম বা মাহফুজ আব্দুল্লাহ। মহম্মদ ইউনুসের বিশেষ সহযোগী সে। ৮৪ বছর বয়সের ইউনুস জরাগ্রস্ত। সুতরাং খুব স্বাভাবিক যে তাঁর বিশেষ সহযোগীই ইউনুসের হয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাজ করছে। মাহফুজ আলম বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী নয়। তিনি ইসলামপন্থী মৌলবাদী। ‘হিজবুত তাহরীর’ নামে এক জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গেও সে যুক্ত। প্রকাশ্যে যদিও মাহফুজের সঙ্গে ওই জঙ্গি সংগঠনের যোগ নেই। তবে, এটা তাদের কৌশল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কিন্তু ছাত্ররা নিজেদের শিবির পরিচয় গোপন করে শুধু ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ পরিচয়ে সামনে এসেছিল। তারা যে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য, তা এখনই জানাবেনা। সম্ভবত একবারেই জানাবে, তাদের খেলাফত স্বপ্ন সফল করার পর।”
গত ২৮ অগাস্ট এই মাহফুজ আলমকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী পদে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক দায়িত্ব পালনে, প্রধান উপদেষ্টাকে সহায়তা করবেন তিনি।তবে এই প্রথম আন্দোলনের সঙ্গে হাতেখড়ি হয়নি মাহফুজের। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম দাবি করেছেন, ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বন্ধু আখতার হোসেন বা আক্রম হোসেনের মতো আন্দোলনে প্রবল সক্রিয় ছিলেন না। আর এবার যখন নাহিদদের হাত ধরে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি’ আত্মপ্রকাশ করে, তখন আন্দোলন নিয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পায় মাহফুজের।তবে বরাবর ব্যাকফুটে থাকা মাহফুজকে নিয়ে এত বিতর্ক কেন ? সম্প্রতি বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানোর তথ্য ও ছবি সমাজমাধ্যমে প্রকাশ করেন তিনি। সেই ছবিতে মাহফুজ আলমকে দরবার হলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তিনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবিটি তুলেছেন, সেখানকার দেয়ালে আগে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছিল। অথচ তিনি যে ছবিটি পোস্ট করেছেন, সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখা যায়নি। শুধু তাইই নয়। ওই পোস্টে মাহফুজ আলম লেখেন, ‘’৭১-পরবর্তী ফ্যাসিস্ট নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দরবার হল থেকে সরানো হয়েছে। এটা আমাদের জন্য লজ্জার যে আমরা ৫ আগস্টের পর বঙ্গভবন থেকে তাঁর ছবি সরাতে পারিনি। ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু মানুষের মধ্যে জুলাইয়ের চেতনা বেঁচে থাকা পর্যন্ত তাঁকে কোথাও দেখা যাবে না। শেখ মুজিব ও তাঁর মেয়ে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে যা করেছেন, তার জন্য আওয়ামী লীগকে অবশ্যই দায়স্বীকার করতে হবে, ক্ষমা চাইতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে—অগণতান্ত্রিক ’৭২-এর সংবিধান থেকে শুরু করে দুর্ভিক্ষ, হাজার হাজার কোটি অর্থ পাচার, হাজার হাজার ভিন্নমতাবলম্বী ও বিরোধীদের বিচারবহির্ভূত হত্যা (১৯৭২-১৯৭৫ এবং ২০০৯-’০২৪)। তাহলেই আমরা ’৭১-এর আগের শেখ মুজিবের কথা বলতে পারি। ক্ষমা প্রার্থনা ও ফ্যাসিস্টদের বিচার ছাড়া কোনও ধরনের পুনর্মিলন হবে না।’
সমাজমাধ্যমে একের পর এক পোস্ট করে শেখ পরিবারের তুলোধনা করছেন এই মাহফুজ আলম। তাঁর আরও এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, পতিত শেখরা। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের কথা শেখ মুজিবুর রহমানের দল ও পরিবারের সদস্যদের স্বীকার করা, ক্ষমা চাওয়া এবং এ জন্য বিচারের মুখোমুখি হওয়া উচিত। তাঁদের আরও উচিত, মুজিববাদী রাজনীতি ও শেখ পরিবারের বন্দনা বন্ধ করা।
সবমিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে শেখ পরিবারকে উৎখাত করার পিছনে এই মাহফুজ আলমের অন্যতম ভূমিকা রয়েছে বলেই ক্রমশ তা স্পষ্ট হচ্ছে।