মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ সেখানে সরকার ব্যক্তিগত জীবনের নিয়ন্ত্রণও থাকে সরকারের হাতের মুঠোয়। কে কোথায় থাকবেন, কী কাজ করবেন, কী নিয়ে পড়াশোনা করবেন, কীরকম পোশাক পরবেন, কীভাবে চুল কাটবেন, সমস্তটার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এমনকি মানুষজনের মোবাইলের অপারেটিং সিস্টেমও এমনভাবে তৈরি, যা নিজে থেকে ফোনের স্ক্রিনশট তুলে পাঠিয়ে দেয় সরকারের কাছে। ফোনে মানুষজন কী দেখছেন, তাও চলে যায় একনায়ক শাসকের হাতে। এখানেই শেষ নয়, দাদু অপরাধ করতে তাঁর নাতিকেও দাদুর শাস্তি ভোগ করতে হয়। এরপরও কিম জং উনের নিয়ন্ত্রণ যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে। একটা অদৃশ্য বিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছে। যা শুরু হয়েছে সেখানকার মহিলাদের তত্ত্বাবধানে।
১৯৮১ সালে উত্তর কোরিয়ার রাজনৈতিক সংশোধনাগারে এক অন্তঃস্বত্ত্বা মহিলাকে বন্দি করা হয়েছিল। জেলেই সন্তানের জন্ম দেন ওই মহিলা। শিন ডং হিয়াক নামের ওই শিশুটি জেলেই বেড়ে উঠতে থাকে। উত্তর কোরিয়ার সরকার গিল্ট বাই অ্যাসোসিয়েশনের নিয়মে চলে। অর্থাত্ দাদু কোনও রাজনৈতিক অপরাধ করলে, তার নাতিকেও তার সাজা ভোগ করতে হয়। ৩টি প্রজন্মকে সেই সাজা ভোগ করতে হয়। ছোট থেকেই জেলে বড় হতে থাকে শিন ডং হিয়াক। জেলে শুধুমাত্র ভুট্টার দালিয়া খেতে দেওয়া হত তাকে। বেঁচে থাকার জন্য ঘাস এবং ইঁদুর খেত সে। ওই জেলে প্রায় ২০ হাজার বন্দি ছিল। সেখানকার কঠোর নিয়ম ছিল। কেউ জেল থেকে পালাতে চাইলে তাকে গুলি করে মেরে দেওয়া হয়। কেউ পালাতে চাইছে, এমনটা জেনেও যদি রিপোর্ট না করে, তাকেও মেরে ফেলা হবে। ১৩বছরের শিন ডং হিয়াক তার মা ও দাদার জেল থেকে পালানোক পরিকল্পনা শুনে নেয়। বাড়তি খাবার পাওয়ার আশায় মা ও দাদার পরিকল্পনার কথা জেলের নিরাপত্তারক্ষীকে জানিয়ে দেয় সে। ৭মাস পর জেলের সমস্ত কয়েদিকে একটি মাঠে ডাকা হয়। শিন ডং হিয়াকের চোখের সামনে তার মাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তার দাদাকে গুলি করে মারা হয়। তারপর ৬মাস ধরে শিন ডংয়ের উপর নির্মম অত্যাচার চালানো হয়।
২০০৫ সালে শিন ডং নিজে জেল থেকে পালায়। নিরাপত্তাপরক্ষীদের নজর এড়িয়ে পালাতে সফল হয় সে। উত্তর কোরিয়া থেকে চিন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছে যায়। পরবর্তীকালে শিন একজন মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর গলার স্বর পৌঁছে যায় রাষ্ট্রসংঘে। নিজের জীবনকাহিনীর যাবতীয় তথ্য একটি বইতে প্রকাশ করেন শিন। বইয়ের নাম এসকেপ ফ্রম ক্যাম্প ১৪। এইভাবেই তাঁর জীবনকাহিনী সম্পর্কে জানতে পারে গোটা বিশ্বের মানুষ। উত্তর কোরিয়ায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষের বসবাস। বিশ্ব মানচিত্রে লক্ষ্য করতে দেখা যায় দক্ষিণ কোরিয়ার উপরেই রয়েছে উত্তর কোরিয়ার। তার পশ্চিমেই রয়েছে চিন। রাতের স্যাটেলাইট ইমেজে চোখ রাখলে দেখা যায়, দক্ষিণ কোরিয়া ও চিন আলোয় ঝলমল করছে। কিন্তু মাঝখানে উত্তর কোরিয়া ডুবে রয়েছে নিকষ কালো অন্ধকারে। উত্তর কোরিয়ার অফিশিয়াল নাম হল – ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অফ কোরিয়া। ডেমোক্রেটিক অর্থাৎ গণতান্ত্রিক দেশ। যদিও কোনও গণতন্ত্রই নেই সেদেশে। যা রয়েছে, তা হল একনায়কতন্ত্র।
উত্তর কোরিয়ায় রাতের বেলায় মানুষ পড়াশোনা করতে পারেন না, টিভি দেখতে পারেন না। মানুষ সন্ধে ৭টার সময় ঘুমিয়ে পড়েন।
১৯৯৫ সালে উত্তর কোরিয়া থেকে ক্রমশ গায়েব হয়ে যাচ্ছিল ব্যাঙ। পরে জানা যায়, সেখানকার মানুষ এতটাই অভুক্ত ছিল যে ব্যাঙ ধরে খেতে বাধ্য হন। ১৯৯৫ ও ১৯৯৮ সালের মধ্যে উত্তর কোরিয়ায় যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তা সবচেয়ে বড় মানুষের তৈরি বিপর্যয় বলে অভিহিত করা হয়। দুর্ভিক্ষের জেরে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। মৃতের সংখ্যাটা প্রায় ৫ – ২০ লক্ষ। যদিও আসল সংখ্যাটা কোনওদিনও প্রকাশ্যে আনেনি সরকার। উত্তর কোরিয়ার অবস্থা সবসময় এমন ছিল না। একসময় দক্ষিণ কোরিয়ার থেকে ভালো ছিল উত্তর কোরিয়ার অবস্থা। ১৯৮০ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ও চিনের থেকেও বেশি ছিল উত্তর কোরিয়ার জিডিপি। বিনামূল্য চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান, যাতায়াত সহ একাধিক পরিষেবা দেওয়া হত। ১৯৫০-৮০র মধ্যে উত্তর কোরিয়ার জিডিপি প্রতিবছর ৪.৫শতাংশ করে বাড়ত। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়ার পরই উত্তর কোরিয়ার দুর্দশা শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর কোরিয়া সস্তায় তেল ও খাবার সরবরাহ করত।
দ্য ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত রিপাবলিকস অর্থাৎ ইউএসএসআরের ভেঙে যাওয়ার পর উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতিও কার্যত ভেঙে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় পাওয়ার স্টেশন। অন্ধকারে ডুবে যায় গোটা এলাকা। খিদের জ্বালায় মরতে থাকেন মানুষজন। উত্তর কোরিয়ার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল আমেরিকার মতো দেশ। কিন্তু তার পিছনেও ছিল শর্ত। পারমাণবিক অস্ত্রের কর্মসূচি বন্ধ করলেই উত্তর কোরিয়ার সাহায্য করবে বলে জানায় আমেরিকা। কিন্তু তাতে রাজি ছিল না উত্তর কোরিয়া। এরপর আমেরিকা সহ বেশ কয়েকটি দেশ একঘরে করে দেয় উত্তর কোরিয়াকে।
১৯৯৫ সালের অগাস্টে ভারী বান আসে। সেইসময় আর্থিক অবস্থাও খারাপ ছিল উত্তর কোরিয়ার। দেশের জনতাকে বাঁচাতেও কোনওরকম আপোসে যেতে চায়নি উত্তর কোরিয়ার সরকার। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে। সমস্তটা ঢাকার চেষ্টা করতে থাকে উত্তর কোরিয়ার সরকার। উত্তর কোরিয়ার রাজধানী হল পিয়ংগ্যাং। সেখানে পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণে আছে দেখানোর জন্য সমস্ত ঘরছাড়াদের শহর থেকে বের করে দেওয়া হয়। অনাহারে মৃতদের দেহ রাতারাতি গায়েব করে দেওয়া হয়। রাজধানীতে থাকা শাসকদলের নেতাদের সমস্ত সুযোগ সুবিধা দেওয়া হত। কিন্তু শহরের বাইরের পরিস্থিতি একেবারে হাতের বাইরে চলে যায়। গ্রামীণ এলাকায় উত্তর কোরিয়ার লেখক অ্যান্ড্রিউ নাটসিসের লেখা দ্য গ্রেট নর্থ কোরিয়ান ফ্যামিন বইয়ে লিখেছিলেন, উত্তর কোরিয়ার মানুষজন বেঁচে থাকার জন্য পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের অনাহারে মরতে দিয়েছিলেন। যাতে কমবয়সীদের বাঁচানো যায়। সন্তানদের জীবনরক্ষায় বহু বয়স্ক সদস্য নিজে থেকেই খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন । এই সবকিছুর কারণ ছিল উত্তর কোরিয়ার নেতার একনায়কতন্ত্র।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন আমেরিকা, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন মিলে জাপান, জার্মানিকে হারিয়েছিল। তখন থেকে জাপানের দখল থেকে মুক্ত হতে থাকে কোরিয়া। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কোরিয়াকে ২ ভাগে বিভক্ত করে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব থাকবে উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকবে আমেরিকার প্রভাব। যেহেতু উত্তর কোরিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ছিল, সেজন্য সেখানে ছিল কমিউনিস্টদের প্রভাব। জাপানের বিরুদ্ধে লড়া নেতা কিম ইল সুন দেশের নেতা হিসেবে উঠে আসেন। তখন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই একই পরিবারের শাসন চলছে উত্তর কোরিয়ায়। কিম ইল সুংয়ের নাতি কিম জং উন দেশে একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছেন।
মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্তটা সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই দেশে স্কুলের পড়াশোনা বিনামূল্যে। স্কুলে না গেলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। যদিও আসল কথা হল স্কুলে পড়াশোনা হয় না। শিক্ষক ঘুষ নিয়ে ছাত্রদের পড়ায়। ধনী ব্যক্তিরা বাড়তি টাকা খরচ করে প্রাইভেট টিউটর রাখেন। পিয়ংগিয়ংয়ের স্কুলের বহু স্কুলের ছবি সামনে এলেও, তা সবটাই শুধুমাত্র সরকার যেটুকু সামনে এনেছে। কলেজের পর সমস্ত যুবকদের সেনায় কাজ করতে হয়। সময়সীমা ১০বছর পর্যন্ত হতে পারে।
একনায়কতন্ত্র চললেও উত্তর কোরিয়ায় প্রতি ৫ বছর অন্তর ভোট হয়। প্রত্যেক আসনে শুধুমাত্র শাসকদলের সদস্যরাই লড়াই করতে পারেন। তার বিরুদ্ধে কেউ ভোট করলে তাকে দেশদ্রোহী হিসেবে ধরে নেওয়া হবে। শাসকদলের বিরুদ্ধে ভোট করলে, সিক্রেট পুলিশ পৌঁছে যাবে তার ঘরে এবং পাগল ঘোষণা করে দেবে। এই কারণেই উত্তর কোরিয়ার ভোটের হার ৯৯.৯শতাংশেরও বেশি। আসলে ভোটদানের প্রক্রিয়াটাকে সরকার জনগণনার পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করে। যাতে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের আরও বেশি করে দখল নিতে পারে সরকার।
উত্তর কোরিয়ার মানুষ কীরকম পোশাক পরবেন, কীভাবে চুল কাটবেন, তাও সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বর্তমানে নারী ও পুরুষদের জন্য মাত্র ১৫টি করে হেয়ারস্টাইলের অনুমোদন রয়েছে। অর্থাৎ যে বা যারা চুল কাটাবেন, তাদের সরকার অনুমোদিত তালিকা থেকেই বেছে নিতে পারবেন। অবাক করা বিষয় হল উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের মতো হেয়ারস্টাইল নেই সেই তালিকায়। কারণ কিম জং উনের মতো হেয়ারস্টাইল, তাঁর মতো চশমা পরার অধিকার নেই কারোর। উত্তর কোরিয়ায় টাইট জিন্স, ব্লু জিন্স, রিপ্ড জিন্স, স্কিনি জিন্স পরার নিয়ম নেই। এছাড়া ব্র্যান্ডেড জামাকাপড়েও নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে উত্তর কোরিয়ার সরকার। কারণ সেখানকার সরকার মনে করে, এর ফলে দেশের মানুষের মধ্যে পাশ্চাত্য দেশের প্রভাব পড়বে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ছোট পোশাক, সান হ্যাট পরা যাবে না বলে নিয়ম জারি রয়েছে। সবমিলিয়ে পাশ্চাত্য দেশের প্রভাব যেন পোশাকে না থাকে। মহিলারা লাল লিপস্টিক লাগাতে পারবেন না। চড়া মেকআপও করতে পারবেন না মহিলারা। চুল রং করার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এইসবকিছু নজরে রাখে ফ্যাশন পুলিশ। লুকিয়ে মানুষজনের উপর নজরদারি চালায় এই ফ্যাশন পুলিশ। নিয়ম অমান্য করে জামাকাপড় পরলে তা কেটে দেওয়া হয়। প্রয়োজনে ফাইন দিতে হতে পারে। এমনকি জেল পর্যন্ত হতে পারে।
পোশাকবিধির উপরে নিষেধাজ্ঞার কারণ হল- সরকার এটাকে সাংস্কৃতিক আক্রমণ হিসেবে দেখে। দেশের মানুষ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকলে, নিজের দেশের সংস্কৃতিকে আর তাঁরা পছন্দ করবেন না। যা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।
উত্তর কোরিয়ায় এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে গেলেও সরকারের অনুমোদন নিতে হয় মানুষকে। সরকারি অনুমোদন ছাড়া দেশের বাইরেও যেতে পারবেন না উত্তর কোরিয়ার বাসিন্দারা। বিনা অনুমোদনে বিদেশে গেলে, তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে গণ্য করা হবে। বিনা অনুমোদনে দেশের বাইরে গেলে, তার পুরো পরিবারের সদস্যদের চরম নির্যাতন, কারাদণ্ড এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। শিন ডংয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শিন ডংয়ের এক কাকা দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। এর জেরে পুরো পরিবারকে জেলে পুরে দেয় উত্তর কোরিয়ার সরকার। একাধিক প্রজন্মকে জেলে কাটাতে হয়েছে। কোভিডের পর সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষীদেরকেও কড়া নির্দেশ দিয়েছিল উত্তর কোরিয়ার সরকার। কেউ বর্ডার দিয়ে দেশ ছাড়ছে বা দেশে ঢুকছে, এমন কাউকে দেখলেই গুলি চালাতে হবে বলে জানিয়ে দেয় সরকার। এই নির্দেশের পর অন্তত ১৪জনের মৃত্যু হয়েছে। এরপরও বহু মানুষ পালানোর চেষ্টা করেন। বেশিরভাগ মানুষ পালিয়ে চিন যান। কিন্তু চিনের সরকার এদের হাতে পেলেও তাদের উত্তর কোরিয়ার হাতে সপে দেওয়া হয়। ২০২৩এ জোর করে ৫০০ মানুষকে উত্তর কোরিয়ায় ফিরিয়ে দিয়েছে।
বিনোদনের ক্ষেত্রেও কড়া নজরদারি রয়েছে উত্তর কোরিয়ার শাসকের। কোনও বিদেশি সিনেমা মুক্তি পায় না উত্তর কোরিয়ায়। এখানে টিভি ও রেডিওতেও সরকারি চ্যানেল আসে। বিদেশি শো এবং সিনেমা দেখলেও কড়া শাস্তি হতে পারে। ২০২২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ান নাটক দেখার অভিযোগে এক কিশোরকে ১২বছরের কঠোর শ্রমের সাজা দেওয়া হয়। ২০২২-এ আরেকটি খবর উঠে আসে। দক্ষিণ কোরিয়ার গান ও সিনেমা দেখার অপরাধে এক যুবককে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয়। মানুষজন লুকিয়ে সিনেমা ব্ল্যাক করেন। আগে ডিভিডি ব্ল্যাক করা হত। ঘর অন্ধকার করে সাউন্ড কমিয়ে এই ছবি দেখতেন মানুষজন। খবর পেলেই ঘরে ঢুকে ডিভিডি উদ্ধার করত পুলিশ। তার সঙ্গে মিলত কঠোর সাজা। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে কড়া প্রহরা। ইন্টারনেট চালানোর জন্যও নিতে হয় সরকারি অনুমোদন। একজন লাইব্রেরিয়ান ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সামনে বসে থাকেন। একজন মাত্র ১ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। ৫মিনিট পর পর কম্পিউটার ফ্রিজ হয়ে যায়। তা ঠিক করতে লাইব্রেরিয়ানের ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রয়োজন।
উত্তর কোরিয়ার ইন্টারনেট ইন্ট্রানেট নামে পরিচিত। উত্তর কোরিয়ার মানুষজন ফোন ও কম্পিউটারে এই ইন্ট্রানেট ব্যবহার করেন। যেখানের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থাকে সরকারের হাতে। কোন কোন ওয়েবসাইট সেখানে চলবে, তাও নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এই ইন্ট্রানেট এতটাই মূল্যবান যে অধিকাংশ মানুষ এটি ব্যবহার করতে পারেন না। উত্তর কোরিয়ায় কোনওরকম সোশ্যাল মিডিয়া নেই। ফেসবুক, নেটফ্লিক্সের মতো ক্লোন বানানোর চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। যে স্মার্টফোন উত্তর কোরিয়ায় ব্যবহার করা হয়, তাতে নির্দিষ্ট সময়ে নিজে থেকেই স্ক্রিনশট নেনয় ফোনের অপারেটিং সিস্টেম। তা সরাসরি চলে যায় সরকারের হাতে। যার মাধ্যমে মানুষ ফোনে কী করছেন, তাতেও নজরদারি চালায় সরকার। ইন্টারন্যাশনাল কল করার ক্ষেত্রেও জারি রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। কোনও অ্যাপ ডাউনলোড করতে গেলেও স্থানীয় দোকানে যেতে হয় মানুষজনকে।
উত্তর কোরিয়া একটি নাস্তিক দেশ। কোনও ধর্মীয় আচার পালন করার অধিকার নেই মানুষের। ধরা পড়লে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে খ্রীষ্টান ও ইসাইদেরকে নিশানা করা হয়। কারণ এদেরকে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হয়। রাজনৈতিক কারাগারে হাজার হাজার খ্রীষ্টান বন্দি রয়েছেন। যাদের উপরে অকথ্য অত্যাচার করা হয়। ২০০৯ সালে এক মহিলাকে বাইবেল সরবরাহ করার অপরাধে প্রকাশ্যে খুন করা হয়েছিল। তার স্বামী ও ৩শিশুকে কারাগারে পাঠানো হয়।
উত্তর কোরিয়ায় দুই প্রাক্তন শাসকনেতা কিম ইল সুং ও কিম জং ইলকেই ঈশ্বররূপে পুজো করেন মানুষজন। ঘর, অফিস, স্কুল সহ বিভিন্ন প্রকাশ্য এলাকায় এই দুই নেতার ছবি ও মূর্তি দেখা যায়। সিক্রেট পুলিশ ঘরে ঘরে গিয়ে পরীক্ষা করেন। এই দুই নেতার ছবি না পেলে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। নিজেদের প্রাণকে বাজি রেখেও এই দুই নেতার ছবিতে রক্ষা করতে হবে। না হলে হতে পারে কড়া শাস্তি।
২০২০ সালে উত্তর কোরিয়ার এক মহিলার বাড়িতে আগুন লাগে। এই দুই নেতার ছবি না বাঁচিয়ে মহিলা তাঁর দুই সন্তানকে বাঁচিয়েছিলেন। ওই মহিলার বিরুদ্ধেও মামলা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাঁর দুই শিশুকেও চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়নি। এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, তাঁর বাবা না জেনেই খবরের কাগজে ছাপা কিম জং-য়ের ছবি নোংরা করে ফেলেছিলেন। সেই অপরাধে রাজনৈতিক কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে।
উত্তর কোরিয়ায় অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে, দেশের ৬৯শতাংশ মানুষ দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগার করতে পারেন না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যেরও একই অবস্থা। বেশিরভাগ বাড়িতে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, সাইকেলের মতো নিত্যব্যবহৃত জিনিসও নেই। বেশিরভাগ মানুষ সরকারি চাকরি করেন। তাঁরা ১৯৯০-র আগের স্কেল অনুযায়ী বেতন পান। যা এতটাই কম যা কল্পনা করতে পারবেন না। নিজেদের মাসিক বেতনে মাসে ৭ থেকে ৯ কেজি ভুট্টা কিনতে পারবেন। ২০১৪ সালে উত্তর কোরিয়া ছেড়েছিলেন এক চিকিৎসক। তিনি জানিয়েছিলেন, প্রতি মাসে ৩হাজার ৫০০ওন বেতন পান তিনি। যাতে এক কেজি চালও কেনা যায় না। পরিবারের পুরুষদের বেতন এতটাই কম যে বাধ্য হয়ে মহিলাদেরও রোজগারের পথে নামতে হয়। যে মহিলারা বিবাহিত, তাঁদেরকে সরকারি চাকরি করতে বাধ্য করা যায় না। তাঁরা স্থানীয় বাজারে জিনিসপত্র বিক্রি করে সংসার চালান তাঁরা। স্থানীয় বাজারকে বলা হয় জাংমাডাং। সংসারের ৭০শতাংশ খরচ করেন মহিলারা। ১৯৯০ সালে যখন সরকার মানুষের পেট ভরাতে পারছিল না, তখন নিজে থেকে রোজগারের পথে নামেন মহিলারা। বিভিন্ন জায়গায় বাজার ও ব্ল্যাক মার্কেট তৈরি হতে থাকে। বিভিন্ন খাবার, মাদক এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ার বেআইনি ইউএসবিও পাওয়া যায়। এই মার্কেটের মাধ্যমে বাইরের দেশের তথ্য জানতে পারেন উত্তর কোরিয়ার বাসিন্দারা।
পুরো দেশের মানুষ কতটা রাজনৈতিক বিশ্বস্ত, তার উপর নির্ভর করে দেশবাসীকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১ নম্বরে রয়েছে কোর ক্লাস, যারা কিমের পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ত। দ্বিতীয় হল ওয়েভারিং। যাদের সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়। তৃতীয় হস্টাইল, যারা সরকারের শত্রু। এই সিস্টেমটিকে বলা হয় সংবুন সিস্টেম। কে কোথায় থাকবেন, তার কী পেশা হবে, সরকার তাকে কতটা খাবার সরবরাহ করবে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা কতটা পাবেন, সম্পূর্ণটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই সংবুনের মাধ্যমে। উত্তর কোরিয়ায় বিয়েও হয় এই সংবুন দেখে।
উত্তর কোরিয়ার পিয়ংগিয়ংয়ে বেশিরভাগ খরচ করে সরকার। যাতা দুনিয়ার লোকের কাছে সবটা বাড়িয়ে দেখানো যায়। সেখানে কোর ক্লাসের মানুষের বসবাস। হস্টাইল ক্লাসের মানুষের এই শহরের ৫০কিলোমিটারের মধ্যে থাকার অধিকার নেই। সরকারের যাদের উপরে সন্দেহ হয়, তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে দিয়েই তাদের উপর নজরদারি চালানো হয়। এর জেরে পরিবারের সদস্যদেরকেও বিশ্বাস করেন না সেখানকার মানুষ। কোনও পরিবারের সদস্য যদি বেআইনি কাজ করেন, তাহলে সংবুন সিস্টেমে তাদের স্তর নীচে নামিয়ে দেওয়া হয়। নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে চাষের ক্ষেত, খনি, কারখানা সমস্ত জায়গায় মানুষকে দিয়ে জোর করে ১২ থেকে ১৮ঘণ্টা করে কাজ করিয়ে নেওয়া হয়। জোর করে কাজ করিয়ে নেওয়া হয়। কারণ দেশের বেশিরভাগ টাকা অস্ত্র তৈরিতে খরচ করা হয়। দেশের পুরো অর্থনীতি এই ফোর্সড লেবারের উপরেই চলছে। ডিটেনশন সেন্টার ও পলিটিক্যাল প্রিজন ক্যাম্পেই ফোর্স লেবারের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এদের জীবন সাধারণ মানুষের জীবনের থেকেও কয়েকগুণ খারাপ। উত্তর কোরিয়ার মানুষ শাসকের বিরুদ্ধে কিছু বললেই শাস্তি হয়। কারাদণ্ডের সেই শাস্তি ৩ প্রজন্ম পর্যন্ত চলে। ১৯৯৯ সালে ধৃত রাজনৈতিক অভিযুক্ত জিয়ং কিয়ংগিল জানিয়েছিলেন, ৫০মিটারের একটি ঘরে ৩০থেকে ৪০জন অভিযুক্তকে রাখা হয়। বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার ৫-৬টি রাজনৈতিক কারাগার রয়েছে। যেখানে ৮০হাজার থেকে ১লক্ষ ২০হাজার মানুষের বসবাস। কয়েদিদের ক্ষেত, খনিতে কাজ করানো হয়। খুব কম খাদ্যশস্য দেওয়া হয় তাদের। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে ঘাস, ইঁদুর, সাপের মতো জিনিসও খেয়ে থাকেন। শুয়োরের খাবারও খেতে বাধ্য হন তারা। একটি ৭বছরের শিশু রাস্তা থেকে খাদ্যশস্য তুলে খাওয়ায় তাকে খুন করে দেয় নিরাপত্তারক্ষী। ক্ষেত থেকে আলু চুরি করার অপরাধে সমস্ত বন্দিদের সামনে হত্যা করা হয় এক বন্দিকে। পালাতে গেলে নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে মৃত্যু হতে পারে বা সীমান্তের তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হতে মৃত্যু হয়।
শিং ডংয়ের বন্ধু পালাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়। পরে সেই ফাঁকা দিয়েই পালিয়েছিলেন শিন ডং। যেকোনও একনায়কতন্ত্র চিরকাল চলতে পারে না। তার সূচনা শুরু হয়ে গিয়েছে বিভিন্ন জায়গায় ব্ল্যাক মার্কেটের মাধ্যমে। বাইরের লাইফস্টাইল সম্পর্কে জানতে পারছেন মানুষজন। দেশের বাইরেও উত্তর কোরিয়ার একনায়কতন্ত্রের বিষয়টিও প্রকাশ্য়ে চলে আসছে।