হুড়মুড়িয়ে পড়ছে মার্কিন ডলারের তুলনায় ভারতীয় মুদ্রার মূল্য। ইতিমধ্যে ডলারের তুলনায় ভারতীয় মুদ্রার দাম কমে হয়েছে ৮৬.৪০টাকা। ফলে মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের। নরেন্দ্র মোদী টাকার ধারাবাহিক পতন রুখতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেও আক্রমণ শানাচ্ছেন বিরোধীরা। বাড়তি মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে বলেও শাসকদলকে নিশানা করছেন তাঁরা। কিন্তু কেন কমছে ভারতীয় মুদ্রার দাম ?
কেনই বা বাড়ছে মার্কিন ডলারের দাম ?আরবিআই কি পারে না ১টাকাকে ১ মার্কিন ডলারের সমান করতে ?
ডলারের দাম কেন বাড়ছে ?
ডলার দাম বাড়ছে কারণ এর চাহিদা বেশি। ৫৪ শতাংশ এক্সপোর্ট ইনভয়সিং ডলারে হয়। ৫৮ শতাংশ গ্লোবাল ফরেন এক্সচেঞ্জ ডলারে হয়। ৮৮শতাংশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রানজ্যাকশনও ডলারে হয়।
এছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রেসিডেন্টের মসনদে বসাটাও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির পিছনে অন্যতম কারণ। ট্রাম্পের নীতি – মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন। এই পলিসির জন্য ভারতীয় মুদ্রার পাশাপাশি একাধিক দেশের মুদ্রায় প্রভাব পড়েছে। ট্রাম্প চান আমেরিকায় বিনিয়োগ বাড়ুক। কমে যাক আয়কর। বিদেশি নয় দেশীয় নাগরিকরা চাকরি পান। ট্রাম্প চান বিশ্বজোড়া বিনিয়োগকারী আমেরিকায় বিনিয়োগ করুন। ট্রাম্প চান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ আমেরিকায় তৈরি জিনিসপত্র আরও বেশি করে কিনুন। এর ফলে আমেরিকায় কর্মসংস্থান বাড়বে। আমেরিকার অর্থনীতির আরও উন্নতি হবে। এর পাশাপাশি চিনা পণ্যে ব্যাপক পরিমাণ ট্যারিফ বা শুল্ক চাপিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যা প্রায় ৬০ থেকে ১০০ শতাংশের মধ্যে। ফলে ট্রাম্পের মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন পলিসির ফলে আরও বেশি করে বিনিয়োগকারীরা আসবেন আমেরিকায়। আর বিনিয়োগকারীরা যদি আমেরিকায় বিনিয়োগ করার সুযোগ পেয়ে যান তবে অন্যান্য দেশে কেন বিনিয়োগ করতে যাবেন তাঁরা ?
বিনিয়োগকারীদের আমেরিকামুখী হওয়ার পিছনেও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তা হল- বিশ্বের ৪৪শতাংশ ধনী ফিন্যান্স কোম্পানি আমেরিকান। বিশ্বেব ৬৫শতাংশ হেলথ কেয়ার আমেরিকান। বিশ্বের ৭৩শতাংশ টেক কোম্পানিও আমেরিকান। আমেরিকান কোম্পানির স্টক মার্কেট ক্যাপ বিশ্বে অর্ধেকেরও বেশি। এই কারণেই আমেরিকার এত আধিপত্য। আর এই আধিপত্যকে আরও বেশি করে বিস্তার করতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী। তারপর একজন রাজনীতিবিদ। সেই কারণেই তাঁর নীতি – নিজে শক্তিশালী হও এবং বাকিদের শক্তিশালী হওয়া থেকে আটকাও। এই কারণেই বিনিয়োগকারীরা চিন, ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আমেরিকায় বিনিয়োগ করছেন। আয়কর কমানো এবং এইচওয়ানবি ভিসা কমানোর ফলে আমেরিকার কর্মচারীরা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। আমেরিকার জন্য এটা উপকারী পদক্ষেপ হলেও, সারা বিশ্বের দেশের জন্য মোটেও উপকারী নয়। কারণ এইসব পদক্ষেপের ফলে ইউএস ডলার শক্তিশালী হয়। কিন্তু বাকি দেশের মুদ্রার মান পড়ে যায়।
কিন্তু মুদ্রার মান বাড়লেই কি দেশের মান বাড়ে ? উত্তর হল না। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক বাহরাইন। ভারতের শহর বেঙ্গালুরুর মাপের একটি দেশ। যাদের মুদ্রা ১ বাহরাইনি-দিনার ভারতীয় ২২৭টাকার সমান এবং ২.৬ মার্কিন ডলারের সমান। তাদের মুদ্রা ডলারের কাছাকাছি হলেও বাহরাইন আমেরিকার মাপের শক্তিশালী কোনওদিনও হতে পারে না। দেশের মুদ্রা ডলারের তুলনায় সস্তা হলেই যে সেই দেশের পরিস্থতি খুব খারাপ তা নয়। উদাহরণস্বরূপ –
১ ডলার ১৫৭ জাপানিস ইয়েনের সমান
১ ডলার ১৪০০ কোরিয়ান ওনের সমান
১ ডলার ২৩,০০০ ভিয়েতনাম ডং-য়ের সমান
১মার্কিন ডলার ভারতীয় মুদ্রায় ৮৬টাকার সমান
১ ডলার ৬৮ আফগানির সমান
তার অর্থ এই নয় যে, আফগানিস্তান ভারতের তুলনায় শক্তিশালী দেশ। আবার জাপান, কোরিয়া ভিয়েতনামের মতো দেশের কারেন্সির মূল্য কম বলেই এর অর্থ এই নয় যে তারা ভারতের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। এক্সচেঞ্জ রেটের বিষয়টি কীভাবে নির্ধারণ করা হয় ?
এর তিনরকম পদ্ধতি রয়েছে। ১. ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট। সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে এই ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট পদ্ধতি রয়েছে। সেখানকার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১ ডলার = ৩.৬৭ এইডি।
২. ফ্লোডিং এক্সচেঞ্জ রেট। যা জাপানে ব্যাবহার করা হয়। যেখানে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক নয় বরং চাহিদা এবং সরবহারের পরিমাণের নিরিখে এক্সচেঞ্জ রেটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৩. ম্যানেজড ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট। যা বাকি দুটি পদ্ধতির সংমিশ্রণ। যা ভারতে ব্যবহার হয়। এখানে আরবিআই একটি আপার ও একটি লোয়ার লিমিটে এক্সচেঞ্জ রেটকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করা হয়। রেটকে অনেক বেশি পড়তেও দেয় না এবং খুব বেশি বাড়তেও দেয় না আরবিআই। যেহেতু ডলারের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, তাই সঞ্চিত ডলার থেকে তা বিক্রি করতে শুরু করবে আরবিআই। যাতে মার্কেটে ডলারের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সুদের হার কমানো হবে, যাতে বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে ভারতে বিনিয়োগ করাটা সহজ হয়ে যায়। যাতে তারা ভারতীয় মুদ্রা কিনে নেন এবং ভারতীয় মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ আরবিআই এক ভারতীয় মুদ্রার চাহিদা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে অথবা বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে।
চিনের দিকে চোখ রাখলে দেখা যায়, চিন ২০১৫ সালে ইচ্ছা করে নিজেদের মুদ্রার দাম ৩শতাংশ কমিয়েছিল। কারণ চিন চেয়েছিল, বিভিন্ন দেশে যাতে চিনা পণ্য আরও সস্তা হয়ে যায়। চিনের তৈরি জিনিসপত্র আরও বেশি করে কিনুক সারা বিশ্ব। বিদেশি কোম্পানিগুলি যাতে চিনে গিয়ে উৎপাদন করে। তার ফলে লাভবান হবে চিন।
বাড়তে থাকা ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ ভারতীয় জণগনের উপরে কি আদৌ কোনও প্রভাব পড়ে ? সাধারণ গরিব মানুষ তো আর আমেরিকায় ঘুরতে যান না, দামি ইম্পোর্টেড জিনিসও ব্যবহার করেন না, তাহলে তারা নিশ্চয়ই ভুক্তভোগী হবেন না ?
উত্তর হল ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সাধারণ মানুষের উপরেও পড়ে। এবং মারাত্মক আকারে পড়ে। কারণ সাধারণ মানুষ পেট্রল কেনেন। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ৮৭শতাংশ তেল কিনেছিল ভারত। যার জন্য ১৩২.৪ বিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছিল ভারতকে। এই সমস্ত পেমেন্ট ডলারেই করা হয়।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এক ব্যারেল তেলের দাম ৭৩ মার্কিন ডলার। এই তেল কিনতে প্রথমে টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হয় ভারতকে। তারপর ডলার দিয়ে সেই তেল কিনতে হয়।
কয়েকদিন আগে ১ ডলারের মূল্য যখন ৮০টাকা ছিল, তখন ৫হাজার ৮৪০টাকা দিয়ে ১ ব্যারেল তেল কিনেছিল ভারত।
এখন ১ ডলারের মূল্য হয়েছে ৮৬টাকা। এবার ৬হাজার ২৭৮টাকায় এক ব্যারেল তেল কিনতে হবে ভারতকে। অর্থাৎ আরও ৪৩৮ টাকা বাড়তি খসাতেই হচ্ছে ভারতকে। এই টাকা কি সরকার দেবে ? উত্তর হল না। আমার আপনার মতো সাধারণ জনগণের উপরেই ট্যাক্স বসিয়ে সেই টাকা তুলবে সরকার।
শুধু যে গাড়িচালকদের উপর এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে, তা নয়। আপনার বাড়িতে আসা শাকসবজির মূল্যবৃদ্ধির কারণও একই। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে শাকসবজি পৌঁছে দিতেও ডিজেল ব্যবহার হয় ট্রাকগুলিতে। তার দাম বাড়লে শাকসবজির দামও তো বাড়বে। অর্থাৎ ডলার দামী হলে তেলও দামী হবে। তেমনই শাকসবজিও দামী হবে। ব্যবসার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে। ভারত যদি দেশের বাইরে থেকে ঋণ নেয় সেক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ে। আগে ১ ডলার ছিল ৮০ টাকা। বর্তমানে তা হয়েছে ৮৬টাকা। প্রায় ৭.৫ শতাংশ রেট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সেই ঋণ মেটাতে গেলে সুদ তো দিতেই হবে। তার পাশাপাশি আরও ৭.৫শতাংশ বাড়তি খরচ করতে হবে। ভারত বাইরে থেকে ৬৮২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। তাতে ৭.৫ শতাংশ যোগ করলে, ৫ বিলিয়ন ডলার বাড়তি দিতে হবে ভারতকে। অর্থাৎ সকলকেই ভুগতে হচ্ছে এর ফল।
ফলে সংসদে আরও বেশি করে সরব হতে হবে। যাতে বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি করে ভারতে বিনিয়োগ করেন। মহামারীর সময় চিন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন বিনিয়োগকারীরা, তখন থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এর ফায়দা নিয়েছে। কিন্তু ভারত লাভবান হতে পারেনি। কারণ নেল কাটার থেকে শুরু করে কম্পিউটার পর্যন্ত বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় ভারতকে। ভারতীয় পণ্যের চাহিদা যখন বাইরের দেশে বাড়বে, তখনই ভারতীয় টাকার মূল্যও বৃদ্ধি পাবে।
টার্কি ১ মিলিয়ন লিরা কে এক লিরা করেছিল ২০০৫ সালে। ভারতেও তো একসময় ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা ছিল। যার আজ আর কোনও মূল্য নেই। তাহলে কি ১টাকা ১ ডলারের সমান করতে পারে না আরবিআই ?
করতেই পারে। কিন্তু কারেন্সি এক্সচেঞ্জ রেট সমস্যা নয়। সমস্যা হল পিপিপি। অর্থাৎ পার্চেসিং পাওয়ার প্যারিটি।
একটি বার্গারের দাম ভারতে ৫০ টাকা এবং আমেরিকায় ১ ডলার হলে। ৫০টাকার বার্গার ১ডলারের বার্গারের সমান।
কিন্তু ভারতীয়দের বেতন আমেরিকার তুলনায় ৮ভাগের ১ ভাগ। আর থাকার খরচ আমেরিকার তুলনায় ৪ ভাগের ১ ভাগ। অর্থাৎ একটি বার্গার আমেরিকায় ৮ডলারে পাওয়া গেলে, ভারতে তা ১৭৮টাকায় পাওয়া যায়। কিন্তু ভারতীয়দের বেতন কম হওয়ায় তাদের আমেরিকার তুলনায় ভারতের দাম বেশি মনে হয়। এই সমস্যার সমাধানও রয়েছে।
ভারতীয় টাকার চাহিদা বাড়াতে হবে। সরকারকে মেক ইন ইন্ডিয়া প্রোডাক্টে জোর দিতে হবে। এফডিআই বাড়লেই জিডিপি বাড়বে। পর্যটনশিল্পে জোর দিতে হবে। একটি শহর দুবাইতেও ৬০মিলিয়ন পর্যটক আসেন। কিন্তু ভারত একটি দেশ হয়েও ১০মিলিয়ন পর্যটক আসেন। পাহাড় থেকে জঙ্গল, মরুভূমি কি নেই ভারতে, তা সত্বেও এত কম পর্যটক। ফলে পর্যটন শিল্পেও জোর দিতে হবে সরকারকে। আমেরিকা সহ বাইরের দেশের পর্যটকদের বা এনআরআইরা যাতে আরও বেশি করে ভারত ভ্রমণ করেন, তাতেও জোর দিতে হবে। তাহলেও আরও বেশি করে ডলার হাতে আসবে ভারতের এবং লাভবান হবে ভারত।