পুরুষ হিসাবে জন্ম নিলেও খুব ছোট থেকেই পুতুল খেলতে ভালো লাগত তার। কথার টানে ছিল মেয়ের ছোঁয়া।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পারেন আসলে পুরুষ নয়, তার মনের অন্দরে ঘুমিয়ে আছে এক নারী। তারপর অনেকটা পথ পার করে অভিষেক কর থেকে আজ বন্য কর হয়ে ওঠা। কেমন ছিল তার লড়াই? নারীদিবসে শুনল আর প্লাস নিউজ
সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংবাদিক: একসময়ে সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টে তার নাম ছিল অভিষেক কর। কিন্তু তার লেখা তার আত্মপ্রকাশ তার সবকিছু দেখেই স্পষ্ট হত ঠিক কতটা নারী হতে চান তিনি! কম অপমান কত হাসিঠাট্টার শিকার হতে হয়নি তাকে! তবু হাল ছাড়েননি। পড়াশোনা করেছেন লিখেছেন। হারিয়েছেন বাবাকেও। একসময়ে ছাড়তে হয়েছে নিজের বাড়িও। নিজের জেদকে অবলম্বন করেই একাই রাস্তায় নেমেছেন। আজ অনেক বন্ধুর পথ পার করে বন্যার আলমারিতে আর পাঞ্জাবি নয়, শাড়িদের মেলা বসে।
ছোটবেলা থেকেই মেয়েলি ভাব স্পষ্ট ছিল তার কথায়। বন্ধু-বান্ধব পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনের হাসি ঠাট্টা তার জীবনের দৈনন্দিন বিষয় হয়ে উঠেছিল। সেইসবকে উপেক্ষা করেই চলছিল অভিষেকের জীবন।
একদিকে পড়াশোনা এর পাশাপাশি লেখালেখি বিকেলে নন্দনে খুব কাছের কিছু বন্ধুবান্ধবদের সাথে কিছুটা সময় কাটানো এই নিয়েই চলছিল তার জীবন। বরাবরই সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করতে চাইতেন তিনি আর এই কারণে মিছিল আন্দোলন এই সমস্ত কিছুর মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। প্রতিবছর রূপান্তরকামী সমকামী তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে যে প্রাইড ওয়াক হতো সেখানে যথেষ্ট উদ্যোগী ভূমিকায় দেখা যেত তাকে।
এর মধ্যেই তার বাবা আচমকা আত্মহত্যা করেন। অভিষেকের জীবন হয়ে ওঠে আরো জটিল। তার মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। একটা সময়ের পর তিনি অনুভব করেন এই পুরুষদের পোশাকে পুরুষ হয়ে তিনি আর বাঁচতে পারছেন না। এবার তার সেই চির আকাঙ্ক্ষিত নারী হয়ে ওঠার সময়। এই সিদ্ধান্ত তার বাড়িতে সেই ভাবে কেউ মেনে নিতে পারেননি। বাড়ি ছাড়তে হয় তাকে। নিজের চাকরির উপার্জনে আলাদাভাবে নিজের একার সংসার শুরু করেন তিনি। শুরু হয় মেয়ে হয়ে ওঠার একটি তীব্র লড়াই। একের পর এক অপারেশন হরমোনাল ইনজেকশন এই সব কিছু তিনি সামলেছেন। প্রথমবার মেয়েদের পোশাকে প্রকাশ্যে আসার পরে অনেকেই তাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছেন কিন্তু তিনি দমে যাননি।
একটা সময়ের পর অভিষেক হয়ে উঠলেন বন্যা। বন্যা কর লেখিকা সমাজকর্মী এই পরিচয় হলো তার। ইতিমধ্যেই তার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে আর সেই সবকটা বই হট সেলার এমনটা বলাই যায়। আজ আর তাকে জোর করে পুরুষদের পোশাক পড়তে হয় না শাড়ি থেকে শুরু করে জিন্স টপ ভর্তি রয়েছে তার আলমারিতে।
আজকের বন্যা অনেক কিছুই পেয়েছেন। কিন্তু আজও তাকে পুরোপুরিভাবে মেয়ে হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি আজও অনেকেরই তার আইডেনটিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলে। প্রশ্ন তোলে তিনি তো মা হতে পারবেন না তাহলে কি করে নারী হলেন? কিন্তু বন্যা কর আর এসব ব্যাপারে পাত্তা দেন না তিনি জানেন শুধুমাত্র মা হয়ে উঠতে পারার মধ্যেই নারীত্ব সীমাবদ্ধ নয়। ভালো মানুষ হয়ে বাঁচার মধ্যে নিজের জীবন নিজের ইচ্ছেমতো কাটানো সামর্থ্য রাখার মধ্যে সর্বোপরি তার আত্মস্বীকৃতিই তার আসল নারীত্ব।