ওয়েব ডেস্ক: শাল-পিয়ালের কোলে সবুজে ভরা বনাঞ্চল আর লালমাটির বুক চিরে এগিয়ে গেছে পথ।পথের ধারে শবর, লোধা, মুন্ডাদের, কুর্মীদের বেড়ে ওঠা গ্রাম।
সবুজ বনাঞ্চলের ফাঁকে সোনা রোদের ঝকমকে অলংকারে সজ্জিত জঙ্গলমহল সুন্দরী।
জঙ্গলমহলের অন্তর্গত লোকসভা কেন্দ্র ঝাড়গ্রাম রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। শ্রী চৈতন্যদেবের আমলে এই প্রাচীন জনপদের নাম ছিল ঝাড়িখন্ড।
শহরের ব্যস্ততাপূর্ণ জীবন থেকে বহুদুরে জঙ্গলের বুকে চেনা মাদলের সুর ছাপিয়ে বেজে উঠেছে ভোটের বাদ্য। লোকসভা ভোটের উত্তাপ ছড়িয়েছে পড়েছে সর্বত্রই।
২০০৮ সালের ২ নভেম্বর, ঝাড়গ্রামের সহজ সরল মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল অশনি সংকেত। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ হয়ে উঠেছিল অশান্ত। বারুদের ধোঁয়ায় ঢাকা পড়েছিল সূর্য। রাজনৈতিক অশান্তির বিষ ছড়িয়ে পড়েছিল সারল্যে ভরা তফসিলি জনজীবনে।
মাওবাদী আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর লড়াইয়ের মাঝে পড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল সেখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের। জিন্দালের ইস্পাত কারখানার শিলান্যাস করে ফিরছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তার সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সার ও রসায়ন মন্ত্রী রামবিলাস পাসওয়ান।
তাদের যাত্রাপথে একটি বিষ্ফোরণ হয়। বিষ্ফোরণের তীব্রতা কম থাকায় প্রাণে রক্ষা পেয়ে যান তৎকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এই ঘটনার পরেই জঙ্গলমহলের পরিবেশ অশান্ত হয়ে ওঠে। এরপর রাজ্য রাজনীতিতে এসেছে পালাবদল, মৃত্যু হয় মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষেণজির।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসতেই দ্রুত বদলাতে শুরু করে জঙ্গলমহলের চেহারা। বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে জঙ্গলের রাস্তা পাকা হয়েছে।
পাতকুয়োর জলের বদলে পৌঁছে গেছে কলের জল। চাষবাস, বনজ সম্পদ সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে চলে তাদের জীবিকা। উন্নয়নের খতিয়ান নিয়ে হাজির শাসকদল। প্রতিদ্বন্দ্বিতার আসরে পিছিয়ে নেই বিরোধীরাও। এবার এখানে হতে চলেছে পঞ্চমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা। একনজরে দেখে নেওয়া যাক,
ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে প্রার্থীদের নাম
তৃণমূল কংগ্রেস- বিরবাহা সোরেন
সিপিআইএম- দেবলীনা হেমব্রম
বিজেপি- কুনার হেমব্রম
কংগ্রেস- যজ্ঞেশ্বর হেমব্রম
ঝাড়খন্ড নরেন ও ঝাড়খন্ড অনুশীলন পার্টি– বিরবাহা হাঁসদা
টানা ৯ বার ঝাড়খন্ড লোকসভা কেন্দ্র দখলে রেখেছিল বামফ্রন্ট। রাজ্যে পালাবদলের পর উন্নয়নের ধারা বজায় রেখে এই কেন্দ্রে সিপিআইএম প্রার্থী ডাঃ পুলিন বিহারী বাস্কের থেকে আসন ছিনিয়ে নেন তৃণমূল প্রার্থী উমা সোরেন।
শেষচালে কিস্তিমাত করতে কতটা সক্রিয় থাকতে পারে রাজ্যের শাসকদল সেই জল মাপতে আরপ্লাস নিউজের ক্যামেরা। দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়গ্রামে ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বিরোধী শক্তি। এই কেন্দ্রে এবার লড়াই পঞ্চমুখী হলেও মূলত তৃণমূল ও বিজেপির প্রেস্টিজ ফাইট হয়ে উঠতে চলেছে এই কেন্দ্র।
ভোটযুদ্ধের প্রস্তুতিতে কে এগিয়ে কেই বা পিছিয়ে আছে তা জানতে এবার ঝাড়গ্রামের জঙ্গলমহলের তৃণমূল প্রার্থী বিরবাহা সোরেন-এর মুখোমুখি হয় আরপ্লাস নিউজ। তিনি জানান, “ভোটের পরেও মানুষের পাশে থেকেই কাজ করতে চাই। রাজ্য সরকারের উন্নয়নের ফলে নানা সুযোগ সুবিধা পৌঁছে গেছে জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে। আগামি দিনেও সেই উন্নয়নকে মনে করেই মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসাবে মানুষ আমার পাশেই থাকবে।”
ব্রিগেড ময়দানে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আদিবাসী মানুষের অনুন্নয়ন ও বঞ্চনার বার্তা তুলে ধরতে সিপিআইএম-এর ব্রিগেড সমাবেশে অন্যতম ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল এই কেন্দ্রের সিপিআইএম-প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রমকে।
বিধানসভায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় দেখা গেছে সিপিআইএম-এর তিন বারের বিধায়ক দেবলীনা হেমব্রমকে। ঝাড়গ্রাম কেন্দ্র থেকে আদিবাসী মানুষের চাহিদাকে দিল্লির দরবারে পৌঁছে দিতে দেবলীনার বক্তব্য, “তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে যেভাবে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে বামফ্রন্ট আমলে তার থেকে অনেক বেশি উন্নয়ন হয়েছিল আদিবাসী অঞ্চলে। ১০০ দিনের কাজ চালু হলেও সবাই কাজ পাচ্ছেন না। আদিবাসী ভাতা চালু হয়েছিল বাম আমলে কিন্তু তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আদিবাসী মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না। তাই আদিবাসী উন্নয়ন স্বার্থে ভোট সিপিআইএম-এর পক্ষেই থাকবে।”
জটিল আবহের মধ্যে এবার লোকসভা নির্বাচন হতে চলেছে। ২০১৪ সালে রাজ্যে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই মূলত লড়াই ছিল সিপিএম-এর। এবার রাজ্যে বিজেপির উত্থান একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কেন্দ্রের প্রাক্তন সিপিআইএম সাংসদ ডাঃ পুলিন বিহারী বাস্কের মতে, “মানুষ সন্ত্রাস মুক্ত হয়ে স্বত্বস্ফুর্ত ভাবেই ফিরতে চাইছে। সেক্ষেত্রে সিপিআইএম-ই একমাত্র বিকল্প। ২০১৪-এ ২৫.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে সিপিএম, বিজেপির ভোট সংখ্যার নিরিখে ছিল ১ লক্ষ ২২ হাজার। সেই অনুপাতে বিজেপির উত্থানের প্রশ্নকে গুরুত্ব দিতে নারাজ এলাকার সিপিআইএম নেতৃত্ব।”
এই বিষয় সহমত পোষন করেছেনসিপিআইএম নেত্রী মধুজা সেন রায়। তাঁর বক্তব্য, “সংসদীয় ব্যবস্থায় ভোট অবশ্যই একটা বড় ফ্যাক্টর। সমস্ত রাজনৈতিক দল তাদের মতাদর্শ বা সংগঠন কতটা মজবুত করতে পারল তার পরিমাপের জন্য ভোটের সংখ্যা অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর।” সময় বদলেছে।
এই অঞ্চল থেকে এবার কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন যজ্ঞেশ্বর হেমব্রম। তাঁর বক্তব্য, “এই অঞ্চলে আদিবাসীদের আন্দোলন চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। পঞ্চম তফসিলিভুক্তির দাবি চালিয়ে যাচ্ছে কংগ্রেস। রাজ্য সরকার অলচিকি ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করলেও অধিকাংশ স্কুলেই নেই শিক্ষক, ফলে বাধ্য হয়ে এই অঞ্চলের মানুষ বাংলায় মাধ্যমের স্কুলেই পড়াশুনো করতে বাধ্য হন।”
যেহেতু এই কেন্দ্রে লড়াই পঞ্চমুখী তাই সাঁওতালি অভিনেত্রী তথা ঝাড়খন্ড নরেন ও ঝাড়খন্ড অনুশীলন পার্টি মনোনিত যৌথ প্রার্থী বিরবাহা হাঁসদা। তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু দাবিকে কেন্দ্র করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “মাওবাদী কার্যকলাপে যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের একজন সদস্যও সরকারি চাকরী পায়নি, বরং মাওবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িতদের সরকারি চাকরি দেওয়া হয়েছে। প্রতিপক্ষ হিসাবে তিনি তালিকায় যৌথ ভাবে রেখেছেন তৃণমূল এবং বিজেপিকে।”
তিনি মনে করেন আদিবাসীদের সঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক দলই বঞ্চনা করেছে। তিনি মনে করেন আদিবাসী সমাজে মেয়েদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ভোট বাক্সে মহিলাদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ হবে। বদলেছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ক্রমশ শক্তি বাড়াতে শুরু করেছে বিরোধীদল। ঝাড়গ্রাম আসন দখল করতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি। বিরোধী শক্তি এই গড়ে ঘাঁটি গেড়ে বসতে কতটা সক্ষম হবে এখন তাই দেখার।