ওয়েব ডেস্ক : লাল চিনের গুপ্তচরবৃত্তি বিশ্বের তাবড় গণতান্ত্রিক দেশকে ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় তল্লাটের বড় বড় গণতন্ত্র জি জিনপিং ডকট্রিনের উৎপাতে স্বস্তিতে নেই। গত মার্চ মাসে মেলবোর্নের একটি হোটেল রুম থেকে চিনা বংশোদ্ভূত ৩২ বছরের এক যুবকের মৃতদেহ মেলে। নাম বো ‘নিক’ ঝাও। মেলবোর্নের লাক্সারি কার ডিলার। তদন্তে উঠে আসে মারাত্মক কিছু তথ্য। বো ঝাওকে লাল চিনের গুপ্তচর চক্র দশ লক্ষ অস্ট্রেলিয়ান ডলার অফার করেছিল। মেলবোর্ন থেকে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে তাঁকে লড়তে বলা হয়েছিল। আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, জেতা নিয়ে ভাবতে হবে না।
ওই অফার দেওয়ার পর এতটুকু দ্বিধা না করে বো অস্ট্রেলিয়ার প্রতিগুপ্তচর সংস্থা এএসআইওকে ওই অফারের কথা জানিয়ে দেন। তার পরেই মেলবোর্নের একটি হোটেল রুমে বো ‘নিকে’র লাশ মেলে। কী করে নিক মারা গেলেন সেটা অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ আজও জানতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন পার্লামেন্টে বলেছেন, তাঁর দেশের মাটিতে চিনা এজেন্টদের কাজকর্ম তাঁকে স্বস্তি দিচ্ছে না। বো ঝাওয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাতেই প্রমাণ, জি জিনপিংয়ের আগ্রাসী তত্ত্ব মেনে চিন এখন অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টেও তাদের পোষা এজেন্ট গুঁজতে চাইছে। যদিও চিনা বিদেশ দফতরের মুখপাত্র গেং শুয়াং অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি চিনকে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস বলে কেঁদেছেন।
আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রশান্ত মহাসাগরীয় রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে চিনের সংঘাতের একটি প্রধান কারণ চিনা সফটওয়্যার কোম্পানি হুয়াওয়েইয়ের ফাইভ জি নেটওয়ার্ক। শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপের উন্নত দেশ জার্মানিও এই চিনা নেটওয়ার্কের বিরোধী। গত মাসে জার্মানির গুপ্তচর বাহিনীর প্রধান বলেছেন, হুয়াওয়েইকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। সুতরাং তাতে অংশ না নেওয়াই ভালো। এক তো এই নেটওয়া্র্ক চিনা কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রণ করে। তায় বহির্বিশ্বে লাল চিনের গুপ্তচরবৃত্তির উদ্দেশ্যেই এই ফাইভ জি নেটওয়ার্কের জন্ম। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন পার্লামেন্টে যখন চিনা প্লটের বিবরণ দিতে ব্যস্ত তখন চিনের এক গুপ্তচর অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চান।
তিনি হংকং এবং তাইওয়ানে কমিউনিস্ট চিনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন। এই গুপ্তচরের নাম ওয়াং লিকিয়াং। রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিনিময়ে হংকংয়ে চিনের পদস্থ সামরিক গোয়েন্দা অফিসারদের পরিচয় তিনি ফাঁস করে দিতে রাজি। তাছাড়া, হংকং, তাইওয়ান এবং অস্ট্রেলিয়ায় চিনের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কাজকারবারও তিনি জানিয়ে দিতে প্রস্তুত। ওয়াং লিকিয়াং এ কথাও জানিয়েছেন, ’১৫ সালে হংকংয়ের বই বিক্রেতা লি বো’কে অপহরণ করে চিনের মূল ভূখণ্ডে তুলে নিয়ে যাওয়ার অপারেশনে তিনি যুক্ত ছিলেন। হংকংয়েই বিজনেসম্যান সেজে চিনা ইন্টেলিজেন্সের হয়ে একটি ফ্রন্ট কোম্পানির দায়িত্বও নেন। লিকিয়াংয়ের স্বীকারোক্তি জানার পরেই চিন রেগে কাঁই। তারা বলেছে, ওয়াং লিকিয়াং একজন প্রতারক। আর্থিক প্রতারণা ধরা পড়ার পর থেকেই সে ফেরার। ঠিক এই একই অভিযোগ চিনের কমিউনিস্ট পার্টি তুলেছিল আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের চিনা প্রধান সম্পর্কে।
তিনিও গণতান্ত্রিক ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। তার পরেই বেজিংয়ের কর্তারা তাঁকে চিনে ডেকে পাঠান। সেই থেকে ইন্টারপোলের চিনা কর্তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তাঁর স্ত্রী আন্তর্জাতিক স্তরে বারংবার আরজি জানিয়েও কোনও আশার আলো দেখতে পাননি। পরে চিনা কর্তৃপক্ষ বলে, ইন্টারপোলের চিনা কর্তা ঘুষখোর। সে কারণেই দেশে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর ‘বিচার’ করা হচ্ছে। ওদিকে, আমেরিকায় ধরা পড়েছে এক জাঁদরেল চিনা গুপ্তচর। জিহুয়া ‘এড’ পেং। ’১২ সালে এড পেং আমেরিকার ন্যাচারালাইজড নাগরিক হন। দীর্ঘকাল আমেরিকায় বসবাসের সুবাদে তিনি এতটাই বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সেই ‘এড’ পেংই শেষ পর্যন্ত চিনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে ফাঁসলেন। আমেরিকান আদালতে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দা কর্তা মাইকেল শোব্রিজ বলেছেন, চিনা কমিউনিস্ট পার্টি কোথাও গণতান্ত্রিক সরকার সহ্য করতে পারে না। জি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে যেভাবে চিনারা গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে অপারেট করছে তা থেকে পরিষ্কার, অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রে নাক গলানোর ব্যাপারে তারা আদৌ লজ্জিত নয়। গত সপ্তাহে ব্রিটেন অভিযোগ করে, হংকংয়ে তাদের কনস্যুলেটের এক প্রাক্তন কর্মীকে চিনারা মারধর করেছে। হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ব্রিটেন ইন্ধন জোগাচ্ছে কি না, সে কথা বের করতেই ব্রিটিশ দূতাবাসের ওই প্রাক্তন কর্মচারীর উপর চিনা এজেন্টরা চড়াও হয়। বৃহৎ গণতন্ত্রগুলিতে চিনা অনুপ্রবেশ রুখতে আমেরিকা, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া মন্ত্রিস্তরে আলোচনা করেছে। এর পর থেকেই বেজিং নতুন কোল্ড ওয়ারের অভিযোগ তুলে কাঁদুনি গাইতে আরম্ভ করে দিয়েছে।