Date : 2024-03-28

শ্রীকৃষ্ণ যমুনাতটে গোপিনীদের আহ্বান করেছিলেন কেন? জানুন অপ্রাকৃত রাসের গল্প….

ওয়েব ডেস্ক: শ্রী কৃষ্ণের রাস সম্পর্কে বেশ কিছু অজানা তথ্য আছে। কার্তিক পূর্ণিমার রাত বৈষ্ণবদের বড় প্রিয়। এ রাতেই তাদের প্রাণের উৎসব রাস উদযাপিত হয়। তাই ভজনকুটিরের নিকোনো উঠোনে আলপনা, উঠোনের পূর্ব কোণে টাঙানো ছোট্ট একখানি চাঁদোয়া। তার
নীচেই রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। বড় মায়াময় সে মূর্তি। উঠোনের এক কোণে মঞ্জরীভরা তুলসী গাছের ঝাড়।
কার্তিকের জ্যোৎস্নার দুধ-সাদা আলোয়
আটপৌরে ভজন প্রেমের চেনা পরিবেশ কেমন যেন অপার্থিব সুন্দর হয়ে ওঠে। কাঠের ছোট্ট সিংহাসনে বসানো
যুগলবিগ্রহের চার পাশে গোল করে সাজানো অষ্টসখীর মূর্তি। পরনে জমকালো পোশাক। সামনে ফরাস পাতা। তাতে সাজানো মৃদঙ্গ, মন্দিরা, হারমোনিয়াম,
করতাল এবং আড়বাঁশি। সুগন্ধী ধূপ, আতর এবং ফুলের গন্ধে ম’ ম’ করে চারপাশ।
সন্ধ্যারতি শেষ। কপাল থেকে নাক পর্যন্ত তিলক পরা এক মাঝবয়েসি বৈষ্ণবভক্ত বিগ্রহের দিকে হাতজোড় করে প্রণাম করে তুলে নিলেন আড়বাঁশিটি। গভীর শান্ত
চোখ দুটি বুজে আলতো ফুঁয়ে ধরলেন আলাপ।
রাগ কেদার। বাঁশির সুরে ভজনকুটিরের উঠোনে ক্রমশ বুঁদ হয়ে উঠেছে রাস পূর্ণিমার রাত। ভিড় বাড়ছে আসরে।

এ বার
বাঁশির সঙ্গে ‘নিখুঁত কণ্ঠ’ মিলিয়ে বৈষ্ণবী গেয়ে উঠলেন মহাজনপদ—
“বলয়া নূপুর মণি বাজয়ে কিঙ্কিণী,
রাস রসে রতিরণে কী মধুর শুনি,
জোড়া মৃদঙ্গ বেজে উঠল ‘ধ্রুব তালে’।….”
এটা তো গেল রাস উৎসবের পরিবেশ। কিন্ত এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বড়ই সুক্ষ্ম ও প্রাণবন্ত। ভগবানকে আরাধনার আছে পঞ্চরস। যা হলো, শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মাধুর্য্য। রাসলীলায় এই মাধুর্য্য রসেরই ছড়াছড়ি। সচ্চিদানন্দ ভগবান ত্রিগুণের আধার। সন্ধিনী, সংবিৎ আর হ্লাদিনী। এই হ্লাদিনী শক্তির পূর্ণ প্রকাশ রাসলীলায়। আবার আমাদের দেহে আছে পঞ্চকোষ, যা অঞ্জানের আবরণে আবৃত। পঞ্চকোষ হলো, অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিঞ্জানময় এবং আনন্দময়। এই আনন্দময় কোষে হ্লাদিনী শক্তির নিবিড় সম্পর্ক। একে জাগ্রত করতে ভক্তদের চাই ভগবদ্ প্রেম। যেমন স্বামীস্ত্রীতে সম্পর্ক, একে অন্যের পরিপূরক। স্ত্রী হলো স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী, এই সম্পর্ক পতিপত্নী, কান্তকান্তা ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। এই সম্পর্কে যেমন থাকতে নেই না কোনো লজ্জা, ভয়, ক্রোধ, সংকোচ, ঘৃনা, রাগ, দ্বেষ, অনুকম্পা ইত্যাকার প্রতিবন্ধকতা গুলো। তেমনি ভগবানের সাথে মধুর তথা হ্লাদিনী শক্তির মিলনে যখন কোনো মানসিক প্রতিবন্ধকতা না থাকে, তারই প্রামান্য প্রতিচ্ছবি রাসলীলা। গোপীরা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরুপে পাওয়ার জন্য যমুনার তীরে দেবী কাত্যায়নীর ব্রত করেছিলো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাদের সেই মানস পুরণের তাগিদেই রাসলীলার অনুষ্ঠান করেছিলেন। ভক্তরা যেমন ভগবানের প্রার্থনায় তাঁর একান্ত আপন ভাবনায় নিজেকে উন্মুক্ত করতে সদা উদগ্রীব। তেমনি ভগবানও ভক্তদের অতি আপন জেনে তার জন্য সকল কিছুই করতে প্রস্তুত। ভক্তদের মনের মাধুর্য্য যখন পূর্ণ মধুরিমায় বিগলিত হয়ে, ভগবান চরণে আত্মাহুতি তথা সমর্পিত হয়, তখনই ভগবান তাকে আপনার আলয়ে ঠাঁই দেন। রাসলীলা ভক্ত ও ভগবানের এই পবিত্র মিলনের বিমূর্ত প্রকাশ।
নবদ্বীপের বৈষ্ণব ভজনকুটির বা আখড়া গুলিতে এ ভাবেই পালিত হয় রাস। রাসে শক্তির আরাধনা বলা হয় ‘রস’ থেকেই রাস। রস অর্থে সার, নির্যাস, আনন্দ, হ্লাদ, অমৃত ও ব্রহ্ম বোঝায়।
উপনিষদে বলা আছে ব্রহ্ম রস ছাড়া আর কিছুই নন।
বৈষ্ণব দর্শনে এই রস বলতে মধুর রসকেই বোঝানো হয়েছে। আর পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ হলেন মধুর রসের ঘনীভূত আধার। তাঁকে ঘিরেই রাস। রাস কথাটির আভিধানিক অর্থ হল নারী-পুরুষের হাত ধরাধরি করে মণ্ডলাকারে নৃত্য। যাকে বলা হয় ‘হল্লীবক” নৃত্য। কিন্তু বৈষ্ণবদের কাছে রাস কথাটির ভিন্ন অর্থ বহন করে। তবে এই হল্লীবক নৃত্যের সঙ্গে রাসের সম্পর্ক থাকলেও এখানে নৃত্য আত্মা ও পরমাত্মার। ছন্দ হল উপাসনার মাধ্যম।
শ্রীমদ্ভাগবত পূরণে শ্রীকৃষ্ণ শারদপূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনের
যমুনাতটে গোপিনীদের আহ্বান করেন এবং তাদের অহং বর্জিত বিশ্বাসভক্তি ভাবে তুষ্ট হয়ে সঙ্গদান করেন। তাই বৈষ্ণবদের কাছে রাস আসলে ভক্ত এবং ভগবানের মিলন উৎসব। এই ইষ্টের সাথে মিলনের যে আনন্দ, তাই হলো ‘রতি’। আর রতিপ্রাপ্তির যে প্রকৃয়া, তাইই ‘রতিক্রিয়া’। অনেকে রাসলীলার ব্যাখ্যায় এই ‘রতিক্রিয়া’র কথা প্রসঙ্গে পার্থিব জৈব দৈহিক মিলনের বিষয় টেনে এনে এর ব্যাখ্যার চরমতম অবমাননা করেন। যা মোটেই কাম্য নয়। ‘রাসলীলা’ যে অপ্রাকৃত ও ইষ্ঠের সাথে আত্মায়, আত্মায় দেহে দেহে, প্রতি অনুতে অনুতে মিলন। এ এক অসামান্য আনন্দ উৎসব। বৈষ্ণবদর্শনে রাসের যে ব্যাখ্যাই থাকুক না কেন, বৈষ্ণব আখড়ায় যে ভাবেই রাস পালিত হোক না কেন, শহর
নবদ্বীপ, চৈতন্যজন্মভূমি নবদ্বীপে রাসের চেহারা ঠিক এর ‘বিপরীত’। পূর্ণিমার ভরা রাতে, বিশুদ্ধ

তন্ত্রমতে শতাধিক
শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজো, সঙ্গে আদ্যন্ত
তামসিকতায় ভরা এক দামাল উৎসবের
উদযাপন— সংক্ষেপে এটই হল নবদ্বীপের
রাসের সংজ্ঞা। পূর্ণিমার রাতে দেড়শোর বেশি বিরাট বিরাট শক্তিমূর্তির পুজোর কারণে নবদ্বীপের রাসকে অনেকে ‘শাক্ত রাস’ বলেও অভিহিত করেন।
নবদ্বীপের রাসের উৎস ঠিক কবে, এর উত্তরে
স্থানীয় ইতিহাসের গবেষক ও নবদ্বীপ
পুরাতত্ত্ব বিভাগ থেকে জানা যায়, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে রাসের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল। রাজা হওয়ার পর থেকে 1750 সাল
পর্যন্ত কৃষ্ণচন্দ্র নানা সমস্যায় জর্জরিত
থাকতেন। তার পর থেকে তিনি মঠমন্দির স্থাপন, মেলা উৎসবের সূচনা বা বহু জনকল্যাণমূলক কাজে মনোনিবেশন করেন। 1753-56-র মধ্যে তিনি জগদ্ধাত্রী পুজো, বারোদোলের সূচনা করেন। মনে করা হয় ওই একই সময়ে তিনি নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের রাস
উৎসবের খোলনলচে বদলে দেন।

আরও জানা যায়, কৃষ্ণচন্দ্র নিজে ছিলেন শাক্ত। নদিয়া, অগ্রদ্বীপ,
কুশদ্বীপ এবং উলা এই চারটি সমাজের
সমাজপতি। তার রাজত্বে শুদ্ধাচারে শক্তিসাধনা হোক এটা তিনি মনেপ্রাণে
চাইতেন। পাশাপাশি তিনি পছন্দ করতেন না চৈতন্যদেবকে মঠে-মন্দিরে পুজো করা হোক। তিনি বৈষ্ণববিদ্বেষী ছিলেন না, কিন্তু চৈতন্যদেবকে যাঁরা অবতার বলে পুজো করতেন তাঁদের তিনি ঘোর অপছন্দ করতেন। চৈতন্যদেবের অনুগামীরা
বেদবিধি ও ব্রাহ্মণ্যস্মৃতি মানতেন, এটাও কৃষ্ণচন্দ্রের আপত্তির কারণ ছিল। তিনি রাসপূর্ণিমার রাতে নবদ্বীপে শক্তিমূর্তি
পুজোয় উৎসাহ দেওয়া শুরু করেন। রাজানুগ্রহে অচিরেই সেই উৎসব ছাপিয়ে যায় বৈষ্ণবীয় রাসকে।
শ্রীকৃষ্ণের অষ্টসখীর নাম গুলো হচ্ছে-
1.ললিতা,
2.বিশাখা,
3.চিত্রা,
4.ইন্দুরেখা,
5.চম্পকলতা,
6.রঙ্গদেবী,
7.তুঙ্গবিদ্যা ও
8.সুদেবী ।
রাসের রাত পরমকরুনাময় সচ্চিদানন্দঘন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বড়ই প্রিয় ও অনুরাগের। কৃষ্ণভক্তরা তাই এই রাতে শ্রীকৃষ্ণ সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকে। যাঁরা শুদ্ধ ভক্ত নিশ্চয়ই তাঁরা সেই পরম ইষ্ঠের অস্তিত্বের অনুভব উপলব্ধি করতে পারেন। তাঁদের চরণে মাথা ঠেকিয়ে কোটি কোটি প্রণাম জানাই। আর শ্রীহরির শ্রীচরণে প্রার্থনা করি, সেই পরম সৌভাগ্য সকল ভক্তদের প্রাপ্য হোক