Date : 2024-03-29

সোমেন মিত্রর প্রয়াণ, স্বজন হারানোর বেদনায় মিশল রাজ্য রাজনীতি

ইদানীং শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা কাবু করলেও মনের জোরে ছেদ পড়তে দেননি কখনই। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে অশক্ত শরীরেও চালিয়ে যাচ্ছিলেন রাজনৈতিক কাজ। পথে নেমে প্রতিবাদেও সামিল হতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। তবে আর পারলেন না। বুধবার গভীর রাতে ৭৮ বছর বয়সে এক বেসরকারি হাসপাতালে চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন রাজ্য রাজনীতির ছোড়দা বলে পরিচিত সোমেন মিত্র। বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। পুরনো পেসমেকার বদল করার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাঁকে। সেখানেই বেশি রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। সব শেষ। সেই সঙ্গে শেষ হল রাজ্য রাজনীতির এক বর্ণময় অধ্যায়।

কংগ্রেসি রাজনীতিতে প্রয়াত বরকত গণি খান চৌধুরীর শিষ্য মনে করা হত সোমেন মিত্রকে। শিয়ালদহ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে (বর্তমানে বিলুপ্ত) বেশ কয়েকবার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। প্রণব মুখোপাধ্যায়, গণি খান চৌধুরী, অজিত পাঁজা, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, স‍‍োমেন মিত্র, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েই নব্বইয়ের দশকে আন্দোলিত হত প্রদেশ কংগ্রেস রাজনীতি। ১৯৯১ সালে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। এর পরের বছরই ১৯৯২ সালে প্রথমবারের জন্য প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হন সোমেনবাবু। বাম বিরোধী আন্দোলনে তখন মুখ হয়ে উঠছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম বিরোধী লড়াইয়ের প্রশ্নে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মত ও পথের প্রশ্নে দুজনের মধ্যে লড়াই তীব্র আকার ধারণ করে। যা সময়ের প্রবাহে বড় আকার নেয়। তবে প্রদেশ নেতৃত্বের প্রশ্নে তৎকালীন কংগ্রেস হাইকম্যান্ড আস্থা রেখেছিলেন সোমেন মিত্রের উপরেই। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমেন মিত্রর জায়গায় সেই ১৯৯৮ সালেই নতুন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হন গনি খান চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে রাজ্য রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেস ব্যাকফুটে ঠেলে দেয় জাতীয় কংগ্রেসকেই। তবে সোমেন মিত্র হারিয়ে যাননি। ২০০৭-০৮ সালে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে তিনিও পৃথক দল গঠন করেন। নাম দেন প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেস। তবে সেই দলের আয়ু বেশিদিন ছিল না। দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছাকাছি আসেন সোমেন মিত্র-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। রাজ্য রাজনীতিতে বাম বিরোধী আন্দোলনের একমাত্র মুখ হয়ে ওঠা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন সোমেনবাবু। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। সেই প্রথম তাঁর সংসদে পা রাখা।

২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের মুখে পুরনো দল কংগ্রেসে ফেরেন সোমেনবাবু। কেন ছাড়লেন তৃণমূল? সেখানেও লুকিয়ে ছিল অ্ন্য বেদনা। তৃণমূল কংগ্রেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই যে শেষ কথা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দলে অন্য কারোর মতামতের কোনও গুরুত্ব নেই, দলে অসম্মানিত হচ্ছেন, এমন অভিযোগকে সামনে রেখেই তৃণমূল ছাড়েন সোমেনবাবু। তৃণমূল ছেড়ে কংগ্রেসে ফেরেন তাঁর স্ত্রীও। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে বাম-কংগ্রেস আসন সমঝোতা হয়। তৃণমূল ঝড়ে বিরোধীরা উড়ে গেলেও কংগ্রেসের প্রাপ্তি খারাপ হয়নি। বামেদের তুলনায় বেশি সংখ্যক আসন নিয়ে বিধানসভায় শক্তি বৃদ্ধি ঘটায় কংগ্রেস। সেই সময় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন অধীর চৌধুরী। ২০১৮ সালে ফের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হন সোমেনবাবু। প্রদেশ রাজনীতিতে সোমেন-অধীর শীতল সম্পর্ক নিয়েও অনেক কথা শোনা যায়। তবে কাছের লোকেরা মনে করেন, এর বাস্তবিক কোনও ভিত্তি নেই। দুজনেই মনের দিক থেকে কাছাকাছি ছিলেন। এমনকি সোমেনবাবু অসুস্থ হওয়ার পরে নিয়মিত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন , খোঁজখবর নিতেন অধীরবাবু।