Date : 2024-04-28

নিরবিচ্ছিন্ন পরম্পরার স্রোতে বসু মল্লিক বাড়ির পুজো

শাহিনা ইয়াসমিন, রিপোর্টার : পুজো আসতে আর বেশি দেরি নেই। আকাশে বাতাসে পুজোর গন্ধ। পুজো প্রস্তুতি শুরু বারোয়ারির পাশাপাশি বাড়ির পুজোরও। ক্লাবের পুজোতে একদিকে যেমন থাকে থিমের চমক, অন্যদিকে ইতিহাস বিজড়িত বর্ধিষ্ণু বাড়ির পুজোতেও থাকে বনেদিয়ানার মেজাজ । তেমনি এক ঐতিহ্যমণ্ডিত বনেদি বাড়ি হলো বসু মল্লিক বাড়ি। রাধানাথ মল্লিকের হাত ধরেই এবাড়ির দুর্গা পুজোর প্রচলন।

18এ, রাধানাথ মল্লিক লেন। সাকিন বসু মল্লিক বাড়ি। 1831 সাল। রাধানাথ মল্লিক সূচনা করেন এ বাড়ির দুর্গা পুজোর। 190 বছরের পুরনো বসুমল্লিক বাড়ির পুজো। এবাড়ির পুজোর ইতিহাস বসু মল্লিকদের গৌরবজ্জ্বল অতীতকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রেখেছ। বসুমল্লিক বাড়ির পুজো ও ইতিহাস নিয়ে রয়েছে কিছু তথ্য। হুগলি জেলার কাঁটাগোড়ে গ্রামের বাসিন্দা রামকুমার বসু মল্লিক। 1794 সালে কলকাতায় আসেন তিনি। তাঁরই পুত্র রাধানাথ মল্লিক । রাধানাথ মল্লিকের বংশধর হলেন এই বসু মল্লিক পরিবারের সদস্যরা। সালকিয়ার হুগলি ডকইয়ার্ডের প্রতিষ্ঠাতা রাধানাথ মল্লিক। জাহাজ ও অন্যান্য ব্যবসা করে কলকাতায় খ্ব্যাতিমান ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর নামেই কলকাতায় রয়েছে রাধানাথ মল্লিক লেন। কথিত আছে, স্বদেশী আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু ইতিহাসের স্মৃতি জড়িয়ে আছে বসুমল্লিক বাড়ির সঙ্গে। স্বদেশী আন্দোলনের সময় 1905 সালের 27 অক্টোবর এই ঠাকুর দালানে এক ছাত্রসভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই একলহমায় পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় দেড়শো বছর। বয়সের ভার অথচ ঐতিহ্যের ছটায় ঝলমলে বসু মল্লিক বাড়ির আনাচে কানাচে ইতিহাস যেন এখনও ফিস ফিস করে কথা বলে। মধ্যমণি ঠাকুরদালান ঘেরা বসু মল্লিক বাড়ির পরতে পরতে তুলি দিয়ে কে যেন ছিটিয়ে দিয়েছে বনেদিয়ানার রঙ। পাঁচ খিলান ও দু দালান বিশিষ্ট ওই ঠাকুর দালানের উপরিভাগে বিষ্ণুর দশাবতারের ছোট মাটির মূর্তি সারিবদ্ধভাবে দেওয়ালের গায়ে খোদাই করা।

ঠাকুর দালান জুড়ে হস্তিকায় থামের সারির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ জমিদারির স্থাপত্যের নিদর্শন ধরে রেখেছে আজও। দালানের নিচে নামলেই অভর্থ্যনা জানানোর জন্য অপেক্ষারত পরীমূর্তি। প্রতিবছর ঠাকুরদালানেই প্রতিমা তৈরি হয়। পুজো এলেই নতুন মোড়কে সেজে ওঠে অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে থাকা ঠাকুরদালান। বসুমল্লিক বাড়ির পুজোয় রয়েছে বিশেষত্ব। এবাড়ির পুজো হয় নয়দিন ধরে। প্রতিপদ থেকে পুজো শুরু। ষষ্ঠীতে বোধন, তবে বেলগাছের নিচে বোধন হয়।কলাবউ-স্নান গঙ্গাঘাটে হয় না। এবাড়ির নিয়মানুযায়ী ঠাকুরদালানেই কলাবউ স্নান হয়। একচালায় মায়ের পুজো হয়। তবে এখানে দুর্গার বাহন কেশরযুক্ত সিংহ নয়। ড্রাগনের আদলে সিংহ এ বাড়ির দুর্গার বাহন। সন্ধিপুজোয় 108 টি পদ্ম ফোটানো হয়। 108টি প্রদীপও জ্বালানো হয়। নবমীতে আখ ও চালকুমড়ো বলি হয় তরোয়াল দিয়ে। সিঁদুর খেলা দশমীতে আলাদা করে হয় না, কারণ প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত রোজই সিঁদুর খেলা হয় এই বাড়িতে। প্রথা মেনে দশমীর দিনই হয় প্রতিমা নিরঞ্জন। এমনটাই জানান পরিবারের সদস্য পাপিয়া ঘোষ।

বসুমল্লিক বাড়ির পুজোতে মহিলাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুজোর কদিন কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া হয়। কেমন হয় বসুমল্লিক বাড়ির ভুরিভোজের আয়োজন। রইল তারই তালিকা। কায়স্থ বাড়ি হওয়ায় অন্ন ভোগ হয় না। চাল ফল মিষ্টি ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। করোনার জন্য কাটা ফল না দিয়ে গোটা ফল দেওয়া হয়। অষ্টমীর সন্ধ্যায় নুন ছাড়া লুচি ও পাঁচ রকমের ভাজা ভোগ দেওয়া হয়। সন্ধিপুজোয় থাকে ফল, মাখন ও ছানার পদ। এমনটাই জানালেন এই পরিবারের সদস্য অ়ঞ্জনা বসু মল্লিক।

এবাড়ির ছোট ছেলে রূপেন বসু মল্লিক জানান, পুজোর সময় মহিলাদের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের দায়িত্বও কিছু কম থাকে না। পুজোর ব্যবস্থাপনাতে এবাড়ির পুরুষেরা আগের মতই সক্রিয়।
করোনা আবহে পুজো হচ্ছে ঠিকই, তবে তা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই। যদিও রীতিনীতিতে কোনও পরিবর্তন থাকছে না তবু করোনা আবহে কিছু নতুনত্বের ছোঁয়া থাকবে এই বাড়ির পুজোয়। মায়ের কাছে একটাই প্রার্থনা বসুমল্লিক বাড়ির সদস্যদের, পুজোয় ফিরে আসুক আগেকার আনন্দ, জীবন ভরুক আলোয় আলোয়।