গতানুগতিক ভাবেই শুরু হয়েছিল দিনটা। কে জানত এরকম এক ইন্দ্রপতনের খবর আসবে কিছুক্ষণেই। এক মুহুর্তের জন্য একলহমাতেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল চারপাশ। আলোর বেগে চারদিকে খবর, প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যিনি কিনা ডাক দিতেন লড়াই জিতবার। অথচ জীবনের শেষ যুদ্ধটাতে জয় অধরাই থাকল তাঁর।
সায়ন্তিকা ব্যানার্জি, সাংবাদিক: ঠিক এক বছরের পার্থক্য। গতবছর এই দিনেই আলিপুরের এক বেসরকারি হাসপাতাল থেকে আগামীকাল বাড়ি যাবেন সেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ৯ তারিখ সকালেই বাড়ির পথে রওনা হয়েছিলেন। অতি মাত্রায় বেড়ে যাওয়া সিআরপি বা চেস্ট রিয়্যাকটিভ প্রোটিনকে হার মানিয়ে দিয়েছিলেন। আর তার ঠিক এক বছরের মাথায় শেষ বার পাম এভিনিউ থেকে বেরোলেন তিনি, আর ফেরা হবে না সেই চেনা বাড়িতে।
বর্ষাকাল এলেই সিওপিডির কারণে অসুস্থতা বেড়ে যেতে বুদ্ধবাবুর গতকাল থেকেই অসুস্থ ছিলেন তিনি চিকিৎসকরা এসে তখনকার মতো অবস্থা কিছুটা সামাল দেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই তার অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর হয়ে যায়। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে এদিন সকালেও প্রাতরাশ করেছিলেন বুদ্ধদেব বাবু। অবস্থার অবনতি হতেই খবর দেওয়া হয় গৃহ চিকিৎসককে কিন্তু চিকিৎসক আসার আগেই সিভিয়ার কার্ডিয়ল এরেস্ট হয় তার, তবুও চিকিৎসকেরা এসে অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কারোর চেষ্টাতেই আর সাড়া দিলেন না তিনি। চিরঘুমে চলে গেলেন বাম জমানার অন্যতম স্তম্ভ।
বাম জমানার পতনের পর থেকেই নিজেকে একেবা+রে অন্তরালে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবে বাড়িতে বসে খবর রাখতেন রাজ্য রাজনীতির। আগের মতই চিন্তা করতেন বাংলার শিল্প নিয়ে বাংলার ছেলে মেয়েদের চাকরি নিয়ে। ধীরে ধীরে সময় গড়ায় বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বারে অসুস্থতাও, তার স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য তাকে নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ে শোনাতেন। বামেদের ডাকে যখন ব্রিগেড হতো অগণিত বাম কর্মী সমর্থক অপেক্ষা করতেন যদি একবার সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পড়া সেই লোকটা এসে ব্রিগেডের মঞ্চে দাঁড়ায়! একবার ব্রিগেডের আগে ভয়েস রেকর্ড করে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। লোকসভা নির্বাচনের আগেই ডি ওয়াই এফ আই সংগঠনের ডাকে যে ইনসাফ যাত্রার ব্রিগেড হয়েছিল সকলেই ভেবেছিলেন এবারেও যদি তার বার্তা আসে কিন্তু না সেই ইচ্ছে কারোরই সত্যি হয়নি। শরীর আর সায় দেয় নি তার। আজ তার প্রয়াণে আকাশও যেমন মেঘলা ঠিক সেভাবেই মেঘ জমেছে অগণিত বাম কর্মী সমর্থকের মনেও।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল তার সেই সাদা এম্বাসেডরের ডিউটিও। গত বছর বুদ্ধদেব বাবু যখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তখনো সেই গাড়ি হাসপাতালেই ছিল। বুদ্ধদেববাবুর জীবনের কত ওঠা পড়া ঝড় ঝাপটা সাফল্য ব্যর্থতা সবকিছুর সঙ্গী সবকিছুর সাক্ষী ছিল এই গাড়িটাও, আজ বোধহয় তারও খুব মন খারাপ।
সক্রিয় রাজনীতির ময়দান থেকে নিজেকে একেবারেই সরিয়ে রাখলেও তবুও তো তিনি ছিলেন! রাজ্যবাসী জানতেন পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন সেই মানুষটা যিনি কিনা একদিন এই রাজ্যকে সোনার রাজ্য বানাতে চেয়েছিলেন। আজ তার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিশ্বাসটাও চলে গেল। যে শূন্যতা তৈরি হলো তা আর পূরণ হওয়ার নয়। হয়তো বা চলে গেলেন অনেকটা অভিমান নিয়েই। আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন ব্যাটন। আগামী প্রজন্মের বামেদের হাত ধরে হয়তো কোন একদিন এই রাজ্যের বুকে হেরে লাল রংয়ের সূর্য উঠবে, এই বিশ্বাস বুকে নিয়েই বোধহয় অন্য দুনিয়ায় পাড়ি দিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।