মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রোদ্দুর, বৃষ্টি উপেক্ষা করে ওঁরা কাজ করে। মাত্র কয়েকটা ক্লিকেই আপনার ঘরে পছন্তমতো খাবার পৌঁছে দেন বিভিন্ন ফুড ডেলিভারি অ্যাপের এজেন্টরা । ডিজিটাল যুগে খুবই সহজে বিরিয়ানি থেকে গরম গরম পিজ্জা সহ মনমতো খাবার পেয়ে যাচ্ছেন আপনার ডাইনিং টেবিলে। ফরমাইশ মেনে যাঁরা আপনার পছন্তমতো খাবার আপনার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁদের পোশাকী নাম – গিগ ওয়ার্কার্স (GIGA Workers)। ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর অ্যাপলায়েড ইকোনমিক রিসার্চের (NCAER) সমীক্ষা অনুযায়ী, গিগ ওয়ার্কাররা সপ্তাহে গড়ে ৬৯.৩ ঘণ্টা কাজ করেন। যা সপ্তাহে ৭দিন ১০ঘণ্টা কাজের সমান। রবিবারের ছুটিও মেলে না।
৮ থেকে ১২ঘণ্টা বাইক চালাতে হয় তাঁদের। একজন গিগ ওয়ার্কার যে হারে কাজ করেন। শিক্ষিত হওয়া সত্বেও তাঁরা যে পরিমাণ আয় করেন, তা চোখে আঙুল দিয়ে তাঁদের দুরাবস্থা তুলে ধরে। ৭৫শতাংশ গিগ ওয়ার্কার অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। বিপুল পরিমাণ কাজ করলেও, মাসে মাত্র ১৮হাজার টাকা আয় করেন তাঁরা।
গিগ অর্থাত্ অস্থায়ী কাজ বা পারফরম্যান্স অ্যাক্ট। অতীতে মিউজিশিয়ান বা কমিডিয়ানকেই এই গিগ ওয়ার্কারদের আওতায় ফেলা হত। ফ্রিল্যান্স কর্মীদেরকেও এর আওতায় ফেলা হয়। এদেরকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। সার্ভিস বেসড গিগ ওয়ার্কাস এবং নলেজ বেসড গিগ ওয়ার্কার্স।সার্ভিস বেসড গিগ ওয়ার্কাসদের মধ্যে পড়েন ডেলিভারি এজেন্টরা। যেমন জোম্যাটো, সুইগি, জেপ্টো, আরবান ক্ল্যাপ, উবার, ওলার মতো কোম্পানির কর্মীরা।
অন্যদিকে নলেজ বেসড গিগ ওয়ার্কাসদের মধ্যে পড়েন ডেটা সায়েন্টিস্ট, কনসালট্যান্সির কর্মীরা।এইসব কোম্পানিগুলির সুবিধা হল কর্মীদের সঙ্গে এদের কোনও চুক্তি থাকে না। যখন খুশি হায়ার এবং যখন খুশি ফায়ার করতে পারে কোম্পানিগুলি। অন্যদিকে কর্মীরাও যখন খুশি, যেখানে খুশি কাজ করতে এবং ছাড়তে পারেন। একইসঙ্গে একাধিক জায়গায় কাজ করতে পারেন। কিংবা একটি মূল কাজের পাশাপাশি ফ্রিলান্সিং হিসেবে কাজ করতেও পারেন। শুনতে সহজ মনে হলেও বাস্তবের ছবিটা একেবারেই আলাদা।
নীতি আয়োগের ২০২২-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, কোভিডকালে দেশে প্রায় ৩০লক্ষ গিগ ওয়ার্কার ছিলেন। ২০২১ সালে তা ৭৭ লক্ষ হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ২০৩০-এ সংখ্যাটা ২.৩৫ কোটিতে পৌঁছবে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট অনলাইন লেবার ইনডেক্স বলছে, ভারতে অনলাইন লেবার মার্কেট শেয়ার ২৪ শতাংশ। এই দিক থেকে ভারত ১ নম্বরে। এর থেকেই স্পষ্ট ভারতের গিগ ওয়ার্কারদের জন্য এটি মোটেও ফ্রিলান্সিং কাজ নয় বরং স্থায়ী, পেট চালানোর জন্য কর্মসংস্থান। ২০২৪-এর ইপসোস রিসার্চ প্রাইভেট লিমিটেডের প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে ৮৮ শতাংশ গিগ ওয়ার্কার পেট চালানোর জন্য ওই কাজের উপরেই নির্ভরশীল। অন্যদিকে ফ্লোরিশ ভেনচার ২০২০-র রিসার্চের তথ্য বলছে, লকডাউনের ৬ মাস পরে ৯০ শতাংশ গিগ ওয়ার্কার জানিয়েছেন, তাঁদের আয় নিম্নমুখী হয়েছে। ৪৭ শতাংশ গিগ ওয়ার্কার জানাচ্ছেন, করোনাকালে তাঁদের প্রাপ্ত টাকায় সংসার চালাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। জমানো টাকাও তুলতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা।
করোনাকালে এই গিগ ওয়ার্কারদের করোনা যোদ্ধা, ফ্রন্টলাইনার নামে সম্বোধন করা হত। কিন্তু আসলে বাধ্য হয়েই এই কাজের দিকে ঝুঁকছিলেন এই গিগ ওয়ার্কাররা। বর্তমানে এটিই তাঁদের প্রধান কাজ । বাইক ট্যাক্সি কোম্পানিগুলি এদের ক্যাপ্টেন, এক্সপার্ট, পার্টনার বলে সম্বোধন করে। পার্টনার কথাটি মূলত বিজনেস পার্টনারকেই বোঝায়। তাঁদের এমপ্লয়িজ বললে হেলথ ইনস্যুরেন্স, ট্যাক্স সহ একাধিক সুবিধা দিতে হবে বলেই তাঁদের এই পার্টনার সম্বোধন।অক্সফোর্ড ইন্টারনেট, ইনস্টিটিউটের ফেয়ার ওয়ার্ক অ্যানুয়াল রিপোর্ট ভারতের ১১টি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে সমীক্ষা করেছিল। যার রিপোর্ট বলছে, ভারতের সবকটি প্ল্যাটফর্ম যা বেতন দেয় তা দিয়ে সমস্ত খরচ চালানোর পর তাঁদের হাতে আর কিছু থাকে না।
সেন্টার ফর লেবার স্টাডিজ, ন্যাশনাল ল স্কুল অফ ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি বেঙ্গালুরু এবং মন্টফোর্স সোশ্যাল ইনস্টিটিউট মিলে একটি সমীক্ষা করেছিল। হায়দরাবাদে ওলা উবের চালকদের উপর এই সমীক্ষা করা হয়। ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা কাজ করেন এঁরা। কিন্তু যা আয় করেন, তার মধ্যে ৪০শতাংশ পেট্রোল-ডিজেলে খরচ করতে হয়। কোম্পানিগুলি দাবি করে, তারা এইসব কাজের মাধ্যমে মিডলম্যানদের সরিয়ে বাজারে কর্মসংস্থান বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আসলে এরা নিজেই মিডল ম্যানে পরিণত হয়েছে। গিগ ওয়ার্কারদের সমস্ত রাইড, সমস্ত ডেলিভারি এবং সমস্ত সার্ভিসের ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ নিজেদের পকেটে পুড়ে নেয় এরা।
অঙ্কুর নামে একজন গিগ ওয়ার্কার ১২-১৪ঘণ্টা কাজ করতেন। দুই ছেলের বাবা অঙ্কুর আরবান কোম্পানিতে ক্লিনিংয়ের কাজ করতেন। দিল্লি ও গুরুগ্রামে প্রায়ই বাইক নিয়ে যাতায়াত করতেন অঙ্কুর। এরইমধ্যে একদিন দুর্ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি। নিজের চিকিত্সার জন্য ওইদিনের সমস্ত কাজ বাতিল করতে হয় তাঁকে। পরদিন অ্যাকাউন্ট চেক করতে গিয়ে অঙ্কুর দেখেন, আরবান কোম্পানি তাঁর অ্যাকাউন্ট স্থায়ীভাবে ব্লক করে দিয়েছে। ৫টি কাজ বাতিল করায় ব্লক করায় অঙ্কুরের অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়েছে বলে জানায় আরবান কোম্পানি। কাস্টমার নালিশ করলে, লো রেটিং দিলে, কিংবা ছুটি বেশি নিয়ে ফেললে এধরণের পরিণতি হয় গিগ ওয়ার্কার্সদের।অথচ গিগ ওয়ার্কারদের ক্ষেত্রে এই কাজ ছিল ফিলান্সিং। অর্থাৎ যখন তখন কাজ করতে পারেন তাঁরা। কিন্তু বাস্তবে যেধরণের উদাহরণ সামনে আসছে তা গিগ ওয়ার্কারদের দুরাবস্থার দিকেই ইঙ্গিত করছে।
বহু মানুষ আছেন, যাঁরা কোম্পানিগুলির রেটিং ব্যবস্থা বোঝেন না। ড্রাইভার দেরিতে এলে, কিংবা যেকোনও সামান্য সমস্যায় স্টার কমিয়ে দেন তাঁরা। তাই রেটিং দিলে অবশ্যই ৫ স্টার দিন। ডেলিভারি এজেন্টদের রক্তজল করা খাটনিকে গুরুত্ব দিন। খুব বড় ভুল না হলে তাঁদের প্রাপ্য স্টার কমাবেন না।রাজস্থান এবং কর্নাটকে গিগ ওয়ার্কারদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে বেশ কিছু আইন আনা হচ্ছে। যা তাঁদের কাজের পরিস্থিতি ফেরাতে পারে বলা আশা বিভিন্ন মহলের।তবে বিশ্বের বহু দেশে গিগ ওয়ার্কারদের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় দুর্ঘটনার কবলে পড়লে বিমার সুবিধা পান গিগ ওয়ার্কাররা। আমেরিকার ন্যাশনাল লেবার বোর্ড উবার ও লিফট ড্রাইভারদের লেবার ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ইউকে, নেদারল্যান্ডসের দেশে গিগ ওয়ার্কারদের স্থায়ী কর্মী করা হয়েছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার্স ডায়রেক্টিভ পাশ করেছে। যার আওতায় গিগ ওয়ার্কারদের অধিকার সুরক্ষা করা হবে। তাঁদেরকেও স্থায়ী কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সবমিলিয়ে সেই পথে হেঁটে ভারতের গিগ ওয়ার্কারদেরও প্রাপ্য পারিশ্রমিক এবং প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হোক, এমনই দাবি সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশের।