নারায়ণ দে, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের পর এবার কি পাকিস্তানে হতে চলেছে গণঅভ্যুত্থান? ১৯৭১-এর পর আবারও কি টুকরো হতে চলেছে পাকিস্তান? ২৬ অগাস্টের পর প্রশ্নগুলো ফের মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। ওইদিন বালুচিস্তানের মুসাখেল এলাকায় পথচলতি যানবাহনে বড়সড় হামলা হয়। যার ফলে প্রায় ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রথমে কয়েকজন বন্দুকধারী ব্যক্তি গাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের আইডি চেক করছিল। সন্দেহ হওয়ায় কিছু যাত্রীকে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে পর পর গুলি করা হয়। ওই ঘটনায় মৃত ব্যক্তিরা প্রত্যেকেই ছিলেন পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দা। এখানেই শেষ নয়। এর পর ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় ঘটনা বালুচিস্তানের কালাত জেলায়। পরপর থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা হয়। প্রায় ২৫টি থানায় হামলা চলে। পাক সেনার এক অস্থায়ী ক্যাম্পও উড়িয়ে দেয় এই জঙ্গিরা। কোয়েট্টায় সেনা ক্যাম্পে দীর্ঘক্ষণ গুলির লড়াইয়ে ১৪ জন সেনাকর্মীর মৃত্যুর কথাও জানিয়েছে পাক সেনা। এর পরের ঘটনা বালুচিস্তানের সীমান্ত এলাকায়। সেখানে পরপর রেললাইন উড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। সব ঘটনার দায় নিয়েছে বালুচ লিবারেশন আর্মি-সহ তিনটি সংগঠন। কিন্তু কেন এই হামলা? বালুচ লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ কারা? এই সমস্ত হামলার জবাবে পাকিস্তান সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে? কেনই বা ফের পাকিস্তান টুকরো হওয়ার কথা উঠছে? আসুন দেখি…
হামলার সময় নিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা। ২৬ অগাস্ট দিনটি ছিল বালুচ নেতা আকবর বুগতির মৃত্যুদিবস। তিনি স্বাধীন বালুচিস্তান গড়ার ডাক দিয়েছিলেন অনেক আগেই। ২০০৬-এ ২৬ অগাস্ট পাকিস্তান সেনার হাতে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। প্রতিবছর দিনটি পালন করে বালুচরা। চলতি বছর ওই দিনই বালুচিস্তানে সব রকমের জমায়েত নিষিদ্ধ করে পাক প্রশাসন। বালুচদের বিভিন্ন সংগঠন তখনই জানিয়ে দিয়েছিল, পাক প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও মানবাধিকারের উপর আঘাত। আর ঘটনাচক্রে ওইদিন হামলার জন্য বেছে নিয়েছিল বিএলএ। কিন্তু কে এই আকবর বুগতি?
বালুচিস্তানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আকবর বুগতি। ১৯২৬-এর ১২ জুলাই বালুচিস্তানে জন্মেছিলেন আকবর বুগতি। তাঁর বাবা নবাব মেহরাব খান বুগতি ছিলেন বালুচ জাতির প্রধান বা তুমান্দার। আকবর বুগতি স্কুলশিক্ষা করাচিতে। এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। বাবার মৃত্যুর পর পরবর্তী তুমান্দার নির্বাচিত হন তিনি। পরে রাজনীতিতে যোগ। ১৯৫৭-তে প্রথমবার সাংসদ হন। একবছরের জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান। ১৯৭৩-এ বালুচিস্তানের গভর্নরের দায়িত্বও সামলেছেন। ১৯৮৯-তে বালুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০৫-এ বালুচিস্তানে এক চিকিৎসক তরুণীর ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় পাকিস্তান সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন আকবর বুগতি। তবে এই প্রথম নয়। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বালুচিস্তানের দ্বন্দ্ব শুরু থেকেই।
আসলে বালুচিস্তান কোনওদিন পাকিস্তানের অংশ ছিল না। হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই একদিন স্বাধীনও হত বালুচিস্তান, তৈরি হত বালুচদের নিজের দেশ, স্বভূমি। কিন্তু ঘটনাচক্রে তা হয়নি। তারা পাকিস্তানে জুড়ে গিয়েছে। এর নেপথ্যেও রয়েছে ষড়যন্ত্রের ইসিহাস। বালুচিস্তান পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। আফগানিস্তান ও ইরানের সঙ্গে সীমানা রয়েছে বালুচিস্তানের। আয়তনের দিক দিয়ে পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ প্রদেশ বালুচিস্তান। জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ। ২০২৩ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ২৪ কোটি। বালুচিস্তান প্রাকৃতিক সম্পদ-সমৃদ্ধ। সেখানে তেল, কয়লা, সোনা, তামা ও গ্যাসের খনি রয়েছে। এরপরও পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল এটি। বালুচদের ভাষা ও সংস্কৃতি পঞ্জাব ও সিন্ধের বাসিন্দাদের থেকে একেবারে আলাদা। বালুচিস্তানে সবচেয়ে বড় রাজ্য ছিল কালাত। দেশভাগের পরও কালাতের রাজা মীর আহমেদ খান স্বাধীন দেশের দাবি করেছিলেন। ইতিহাসে চর্চিত কালাতের রাজা বালুচিস্তানকে ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভূক্তি করতে চেয়েছিলেন। যদিও কালাতের রাজাকে করাচিতে নিয়ে গিয়ে একপ্রকার জোর করেই পাকিস্তান-অন্তর্ভুক্তিপত্রে সই করিয়ে নেওয়া হয়। স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরও যা মেনে নিতে পারে না বালুচরা।
বালুচিস্তান প্রদেশের বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, পাকিস্তান সরকারের রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস বালুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ। অথচ এই প্রদেশের বাসিন্দাদের কঠোর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিন যাপন করতে হয়। পাকিস্তানের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দরও বালুচিস্তানে, গোয়াদার সমুদ্রবন্দর। ছয় হাজার কোটি মার্কিন ডলারের চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর মূলত এই সমুদ্রবন্দর ঘিরেই গড়ে উঠেছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য দক্ষিণ–পশ্চিম চীন এবং আরব সাগর দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সংযোগ গড়ে তোলা। বালুচিস্তান প্রদেশের বাসিন্দাদের অভিযোগ, পাকিস্তান সরকার খুবই কৌশলে ক্রমাগত তাঁদের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে যাচ্ছে এবং তাঁদের সম্পদের অপব্যবহার করছে। বিনিময়ে কিছুই মিলছে না বালুচিস্তানের বাসিন্দাদের। জাতীয় সংসদেও ৩৩৬ আসনের মধ্যে বালুচিস্তান থেকে মাত্র ২০টি আসন সংরক্ষিত। দেশটির বৃহত্তম রাজ্য বা প্রদেশ হওয়া সত্ত্বেও। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সরকার বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে বালুচদের মধ্যে। ক্রমেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দিকে সমর্থন ঝুঁকে পড়ছে তাদের। বালুচিস্তানে বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন রয়েছে। যেমন লস্কর-ই-বালুচিস্তান, বালুচ লিবারেশন ফ্রন্ট, বালুচ রাজি আজোই সঙ্ঘার ও বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মি। যারা ২৬ অগাস্টের হামলার দায় স্বীকার করেছে। বিএলএ-র সঙ্গে ইরান ও ভারতের যোগ রয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছে পাকিস্তান সরকার। বিএলএ-কে ভারত ফান্ডিং করে বলে অভিযোগ পাকিস্তানের। যদিও পাকিস্তানের এই দাবি কোনওদিনই প্রমাণ হয়নি। অন্যদকে চলতি বছরে পাক-ইরান সংঘর্ষে বিএলএ-র মদত ছিল বলে মনে করে পাকিস্তান।
এটা সত্যি বালুচরা কোনওদিনই নিজেদের পাকিস্তানি বলে পরিচয় দেয় না। অতীতে বহুবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল বালুচরা। ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল বালুচিস্তানের বাসিন্দারা। এরপর বড় বিদ্রোহ হয়েছিল ২০০৫-এ। ২০০৫ সালে বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন আকবর বুগতি। পরের বছর ২৬ আগস্ট নিজের শহর ডেরা বুগতিতে সামরিক অভিযান চালিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। ওইসময় বিএলএ-কে পাকিস্তান জঙ্গি সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করেছিল। তারপর থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আরও জোরদার হয়। ২০০৯-এর এপ্রিলে পঞ্জাব প্রদেশে বিএলএ হামলা চালায়। ২০২১-এর সেপ্টেম্বরেও ফের হামলা চালায় বিএলএ। ওইসময় বালুচিস্তানে থাকা মহম্মদ আলি জিন্নার মূর্তি ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও চিনা পর্যটক বা চিনের অর্থে তৈরি হওয়া প্রকল্পে বার বার হামলা চালায় বিএলএ। ২৬ অগাস্ট, আকবর বুগতির মৃত্যুদিবসে প্রতিবছরই কোনও কোনও হামলা ঘটায় বিএলএ। কিন্তু এবারের হামলা স্বাধীন পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসের ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই হামলার পর পাকিস্তান সরকারের জবাব কী? পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ পর পর হামলার ঘটনার পর মন্ত্রিসভার বৈঠক করেন। সেখানেই তিনি বলেন, বালুচিস্তানের সঙ্গে আলোচনার রাস্তা খোলা আছে। কিন্তু আলোচনা না করে যদি ওরা হামলা করে তাহলে জবাব দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই ২১ জন জঙ্গিকে খতম করার দাবি করেছেন পাক-প্রধানমন্ত্রী।
পাক সরকার ও বালুচদের মধ্যে এই সংঘর্ষ ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। যা থেকেই প্রশ্ন উঠছে, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের পর এবার হয়তো পাক ভূখণ্ডেও গণঅভ্যুত্থান দেখা যাবে। সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামবে বালুচিস্তানের সাধারণ মানুষ। যদি তাই হয়, তাহলে পাকিস্তানের আরও একবার ভাগ হওয়া শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।