পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দেশ স্বাধীন হয়েছিল এক ১৪ অগাস্ট মধ্যরাতে। ৭৮ বছর পর সেই দিনই রাজ্যজুড়ে রাত দখলের লড়াই। দাবিটা স্বাধীনতারই। নির্ভীক স্বাধীনতার। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার। দাবিটা নির্ভয়াদের। তবে শুধু মেয়েরাই নন, দলহীন, পতাকাহীন এই কর্মসূচিতে যোগদান সমাজের সকল মানুষের। রাত ১১ টা ৫৫ থেকে শুরু রাত দখলের লড়াই।ভারতের স্বাধীনতার ৭৮-এ যাতে মেয়েরা স্বাধীনতার সঙ্গে বাঁচতে পারেন, সেই আশায় ১৪ অগাস্ট মধ্যরাত দখল মেয়েদের। তবে এমন আন্দোলন এই প্রথমবার নয়। ১৯৭৫ সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় রাচে বাড়ি ফেরার সময় এখ মাইক্রোবায়োলজিস্ট খুনের পরে মেয়েরা এভাবেই পথে নেমেছিলেন। শুরু হয়েছিল টেক ব্যাক দ্য নাইট নামে এক আন্দোলন।
নির্ভয়াকাণ্ডের পরও দিল্লির রাজপথে নেমেছিলেন নারীরা। রাতের দখল নিন বা রিক্লেম দ্য নাইট নামে আরও এক আন্দোলন দেখেছিল বাংলা থেকে বিশ্ব। সে বারও সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে কলকাতার রাজপথে নেমেছিলেন নারীরা।এবারও একইভাবে মেয়েদের নিরাপত্তায় রাত জেগে প্রহরা মেয়েদেরই। সব ক্ষেত্রেই মূলত প্রশ্ন একটাই রাতের অন্ধকারে কেন নারী সুরক্ষা নেই?
আরজিকরকাণ্ডের তদন্তের গতি-প্রকৃতি
আরজিকরকাণ্ডে মৃত্যুতে তোলপাড় দেশ। ৯ অগাস্ট আরজি করের সেমিনার হল থেকে উদ্ধার হয় এক ডাক্তার তরুণীর অর্ধনগ্ন দেহ। সোদপুরের ডাক্তারি পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও খুনের পর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে উঠে আসে হাড়হিম করা খুনের কাহিনী। মুহূর্তে সেই ঘটনা সাড়া ফেলে দেয় গোটা দেশে। সোদপুরের মেয়ের শেষ রাতের আর্তনাদ শোনা যায় দিল্লির এইমসেও। ইতিমধ্যে এই হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতার করা হয়েছে সঞ্জয়কে। এরপর রাজ্যের তরফে সিট গঠন করে তদন্ত চলছিলই। ১২ অগাস্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত তরুণীর সোদপুরের বাড়িতে গিয়ে তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। এমনকি তিনি কলকাতা পুলিশকে তদন্তের জন্য ডেডলাইনও বেঁধে দেন। না হলে তদন্ত সিবিআইকে দেওয়া হবে বলেও জানান। লালবাজারের তরফে ঘটনার দিনের সাক্ষী বা সন্দেহভাজন বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। তবে এর মাঝেই আচমকা কলকাতা হাইকোর্ট জানায় সময় নষ্ট না করে তদন্তের দায়িত্ব অবিলম্বে দিতে হবে সিবিআইকে। আদালতের নির্দেশ মেনেই ঘটনার ষষ্ঠতম দিনে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিবিআইকে। সঞ্জয়কে সিজিও কমপ্লেক্সে নিয়ে যান দিল্লি থেকে আসা সিবিআইয়ের ৭ সদস্যের দল। সঞ্জয়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে তাকে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয় কলকাতা পুলিশ। যদিও এর মাঝে জলঘোলা হয়েছে অনেক দূর। আরজি করের অধ্যক্ষকে সরিয়ে সিএনএমসিতে স্থানান্তর করা হয়। রাজ্যের এই নির্দেশেও হস্তক্ষেপ করে আদালত। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ জানায়, দ্রুত আরজি করের পদত্যাগী অধ্যক্ষ সন্দীপ রায়কে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে না পাঠালে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে আদালতই। আরজি করকাণ্ডের পর থেকেই কর্মবিরতিতে নেমেছেন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিং হোমের ডাক্তারি পড়ুয়া-চিকিত্সক ও নার্সরা। কর্মবিরতি নিয়ে আন্দোলন চলছে বিভিন্ন রাজ্যেও। সব মিলিয়ে আরজি করকাণ্ডে উত্তপ্ত পরিস্থিতি দেশজুড়ে। এখন প্রশ্ন এই আন্দোলন কি নাগরিক আন্দোলনের রূপ নেবে?
নারী নির্যাতনের ঘটনা অবশ্য দিন-রাত কিংবা ঘরে-বাইরের পার্থক্য করে না। ফুটপাত থেকে বাস-ট্রেন-মেট্রো, নিত্য চলাফেরায় প্রতি মুহূর্তে নিজেদের আড়াল করে চলতে হয়। সদ্যোজাত-শৈশব-কিশোরী-যুবতী-বার্ধক্য জীবনের প্রতিটি ধাপেই মেয়েরা আজও সুরক্ষিত নয়। কোনও বয়সই পৈশাচিক দৃষ্টির শিকার থেকে বাদ পড়েনা। রাত হলেই ঘরে থাকা বাবা-মায়ের চিন্তা বাড়ে বাইরে কাজ করতে যাওয়া মেয়ের জন্য। রাত হলেই মেয়েদের ঘরে ফেরানোর চিন্তায় মগ্ন হন বাবা-মায়েরা। কেন এমন পরিস্থিতি এখনও? প্রশ্ন নারীদের। বড় বড় কবি, লেখকরা বারবার সাম্যের কথা বলেছেন। নারী-পুরুষ বিভেদ নয় বলেছেন। অথচ সেখানে দাঁড়িয়ে আজও মেয়েদের প্রথম পরিচয় তাঁরা মেয়ে, মানুষ নয়। তাইতো ধর্ষণের শিকার হয় শিশুকন্যারাও। আর এইসব প্রশ্নই জোরালোভাবে সর্বসমক্ষে তুলে ধরতে স্বাধীনতার প্রকাল্লে রাত জাগা নারীরা।
এই রাত জাগা নারী আন্দোলনে একদিকে যেমন সামিল হচ্ছেন বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতারা। অন্যদিকে, আরজি করকাণ্ডে পথে নামছেন প্রবীণ তৃণমূল নেতা তথা সাংসদ সুখেন্দুশেখের রায়। মঙ্গলবার রাতে তিনি এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, বুধবার এই প্রতিবাদে সামিল হব। কারণ লক্ষ বাঙালি পরিবারের মতো আমার কন্যা আছে। নাতনি আছে।
কোথাও যেন এই আন্দোলন দল নির্বিশেষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যেন প্রতিটি ঘরের মেয়ের কাহিনী। রাত দখলে বেড়িয়ে যাতে কোনও মা-বোনের অসুবিধেয় পড়তে না হয় সে জন্য সারারাত অটো-বাসের পরিষেবা দেওয়ার মতো ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভূমিকা নিয়েছেন কিছু মানুষ। সবার ওপর মানুষ সত্যই যেন এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। সব মিলিয়ে বলাই যায় এ আন্দোলন যেন সার্বিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে।