এক ঘণ্টারও কম সময় ছিল হাতে। বড়জোর ৪৫ মিনিট। এর মধ্যেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসতে একপ্রকাশ বাধ্য হন বাংলাদেশের সদ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঠিক কী হয়েছিল সেই সময়? বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম-সূত্রে যে খবর মিলছে তার ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন।
তাঁদের একা ফেলে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রয়াত স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের মতন শেখ হাসিনাকে কারাবরণ করানোর পক্ষে ছিলেন অনেকেই। তবে শেষ সময়েও আরও বেশি বলপ্রয়োগ ও রক্তপাতের মাধ্যমে নাকি ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
শুধু নিজ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ মানতে পারছেন না আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীরা। শেখ হাসিনা যে এভাবে সবাইকে রেখে একা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন তা নাকি ঘূণাক্ষরেও টের পাননি কেউ। এমনকি কোনও ইঙ্গিতও পাওয়া যায়নি আগে। প্রাণপ্রিয় নেত্রীর চলে যাওয়ার এমন খবর পাওয়ার পরে মন্ত্রিসভার সদস্য ও দলের নেতাকর্মীরা অনেকটাই হতবিহবল হয়ে পড়েন। তাঁরা বলেছেন, তিনি দেশ ছেড়ে যদি যাবেনই, তা হলে শেষ মুহূর্তে দলের নেতাকর্মীদের কেন আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি দাঁড় করালেন। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শেখ হাসিনা দেশে থেকে কারাগারে গেলে দলের নেতাকর্মীরা এতটা বিপদে পড়তেন না। তাঁরা আরও বলেন, প্রয়াত স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতন হয় গণ অভ্যুথ্থানে। কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে পালাননি। বরং জেলে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হয়ে কীভাবে নেতাকর্মীদের রেখে, বিদেশে চলে গেলেন এটা তাঁদের মাথায় আসছে না। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের এমন বিপর্যয় হবে তা মেনে নিতে পারছেন না দেশের অনেকেই।
তবে শেষ সময়েও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও আরও বেশি রক্তপাতের মাধ্যমে নাকি ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সূত্রের খবর, সোমবার দেশ ছাড়ার আগে রবিবার সকাল দশটা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষকর্তাদের চাপ দিয়েছিলেন তিনি। পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে তা কিছুতেই মানতে নারাজ ছিলেন তিনি। নিরাপত্তা বাহিনী কেন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। শিক্ষার্থীরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সাঁজোয়া গাড়িতে উঠে লাল রং দিয়ে দিচ্ছেন, এমনকি সামরিক যানে উঠে পড়ছেন। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হচ্ছে না, তা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। এছাড়া বিশ্বাস করে যে সব কর্মকর্তাকে শীর্ষ পদে বসিয়েছেন সেকথাও উল্লেখ করেন। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা পুলিশের আইজিপিকে দেখিয়ে বলেন, তাঁরা তো ভালো করছেন। তখন আইজিপি জানান, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গিয়েছে তাতে পুলিশের পক্ষেও আর বেশি সময় এরকম কঠোর অবস্থান ধরে রাখা সমভব হবে না। ওই সময় শীর্ষ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, বল প্রয়োগ করে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা তা মানতে নারাজ ছিলেন। তখন কর্মকর্তারা হাসিনা বোন শেখ রেহানার সঙ্গে আর একটি ঘরে আলোচনা করেন। রেহানাকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে শেখ হাসিনাকে বোঝানোর অনুরোধ করেন। শেখ রেহানা এরপর বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু বোনের বোঝানোয় কাজ হয়নি। ক্ষমতা ধরে রাখতেই নাকি অনড় ছিলেন হাসিনা। এক সময় বিদেশে থাকা হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন এক শীর্ষ আধিকারিক। এরপর জয় তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। তারপরই পদত্যাগে রাজি হন শেখ হাসিনা। তিনি তখন একটা ভাষণ রেকর্ড করতে চান জাতির উদ্দেশে প্রচারের জন্য। ততক্ষণে গোয়েন্দা সূত্রে খবর আসতে শুরু করে, বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও জনতা শাহবাগ ও উত্তরা থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন অভিমুখে রওনা হয়েছে। দূরত্ব বিবেচনায় মাত্র 45 মিনিটের মধ্যে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ থেকে গণভবনে চলে আসতে পারে বলে অনুমান করা হয়। ভাষণ রেকর্ড করতে দিলে, গণভবন থেকে বের হওয়ার সময় নাও পাওয়া যেতে পারে। এই বিবেচনায়, শেখ হাসিনাকে ভাষণ রেকর্ডের সময় না দিয়ে 45 মিনিট সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরানো বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে আসেন হাসিনা। সেখানে তাঁদের কয়েকটি ল্যাগেজ ওঠানো হয়। তারপর তাঁরা বঙ্গভবনে যান। সেখানে পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে, বেলা আড়াইটের দিকে সামরিক হেলিকপ্টারে ছোট-বোন সহ ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন শেখ হাসিনা। ব্যুরো রিপোর্ট, আর প্লাস নিউজ।