মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আরজিকরকাণ্ডে যখন তোলপাড় গোটা বাংলা তথা দেশ। তখনই চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছে হেমা কমিটির রিপোর্ট (Hema Committee Report)। প্রকাশ্যে চলে এসেছে দক্ষিণী সিনেমার তিক্ত সত্য। তারপর থেকেই কেরালা বিনোদন জগতে শুরু হয়েছে মিটু আন্দোলন। পুরুষতান্ত্রিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন অভিনেত্রীরা ও মহিলা কলাকুশলীরা। হেমা রিপোর্ট অনুযায়ী, অভিনেত্রীদের হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে মালয়ালম ছবির অভিনেতা সিদ্দিকী, পরিচালক রঞ্জিত বালকৃষ্ণন-সহ একাধিক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে। দায় স্বীকার করে মঙ্গলবার ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ মালায়ালম মুভি আর্টিস্টসের (AMMA) সভাপতির পদ ত্যাগ করেন মোহনলাল ৷ তাঁর সঙ্গে কার্যনির্বাহী কমিটির সকল সদস্য পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, নিজের ছবির গানের প্রমোশনের জন্য থ্রিসুর থেকে কোচি যাচ্ছিলেন এক নামী অভিনেত্রী গায়ত্রী। নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁর আসল পরিচয় গোপন রাখতে হচ্ছে। গায়ত্রীর গাড়িকে পিছন থেকে ধাক্কা মারে একটি টেম্পো। দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। টেম্পোর লোকজন গায়ত্রীর গাড়িতে ঢুকে পড়ে। অভিনেত্রী গায়ত্রী একজনকে চিনতে পারেন। সুন্নি নামক ওই যুবক মাস্ক সরিয়ে বলে, আপনাকে ফলো করে যৌন হেনস্থা ও ভিডিও তৈরির জন্য সুপারি দেওয়া হয়েছে।
মালায়ালম সিনেমার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত কেরালার কোচি শহর। সেই শহরেই নামি অভিনেত্রীকে তাঁরই গাড়িতে সুপারি দিয়ে যৌন হেনস্থা করা হয়। এধরণের ক্রাইম হলেও পুলিশের থেকে বিশেষ সাহায্য পান না নির্যাতিতারা। মানুষজন জেনে গেলে কয়েকদিন তোলপাড় হয়। পরে সমস্তটা ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু কোচির ঘটনা তার থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। অ্যাসোসিয়েশন অফ মালায়ালম মুভি আর্টিস্টস অর্থাৎ এএমএমএ-র (AMMA) সভাপতির পদ ত্যাগ করতে হয় মোহনলালকে৷ যেসব সিনিয়র অভিনেতাদের নামে মানুষজন মুখ খুলতে ভয় পেতেন, তাদের বিরুদ্ধে মিটু আন্দোলন শুরু হয়েছে। সিট গঠন করেতে হয়েছে কেরালা সরকারকে।
মালায়ালম ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে উন্নত সিনেমার জনক হলেও ১০-১৫জন ক্ষমতাশালীর নেতৃত্বে সেখানে মাফিয়ারাজ চালানো হয় বলে অভিযোগ। ২০১৭ সালের কেস হোক বা হেমা কমিটির রিপোর্ট সবটাই নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা ইন্ডাস্ট্রিকে।
২০১৭ সালের গায়ত্রী হেনস্থার ঘটনায় দিলীপের নাম প্রকাশ্যে আসে। দিলীপ মালায়ালম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় নাম। মামুটি-মোহনলালদের মতো নামজাদা অভিনেতাদের সঙ্গে তাঁর নাম নেওয়া হয়। অনস্ক্রিন অভিনয় এবং অফস্ক্রিন মালায়লম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কিংপিন দিলীপ। ১৯৯২ সালে ক্যামিও দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু। ২০০০ সালে সুপারস্টার তকমা পেয়ে বিজনেস শুরু করেন দিলীপ। ডিরেকশন, প্রোডাকশন, ডিস্ট্রিবিউশন, থিয়েটার ওনারশিপ, রিয়েল এস্টেটের মতো বিজনেসেও বিরাট দখল ছিল দিলীপের। গোটা মালায়লম ইন্ড্রাস্ট্রি নিজের মুঠোয় করে নেয় দিলীপ। দিলীপ এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন যেকোনও অভিযোগ চাপা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর। ২০০৮ সালে মালায়লম সিনে টেকনিশিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য পরিচালক তুলসীদাস অভিযোগ তোলেন, আগাম টাকা নিয়েও ছবির শুটিং করেননি দিলীপ। বিষয়টিকে চাপা দেওয়ার জন্য সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পরিচালকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দিলীপ ফিল্ম এমপ্লয়িজ ফেডারেশন অফ কেরালা নামক নিজের ফেডারেশন খোলেন। এরপর পরিচালক তুলসীদাস আর কোনও কাজ পাননি। এমনই ভুরি ভুরি অভিযোগ উঠেছে দিলীপের বিরুদ্ধে। তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা না করলেই এমন পরিণতি হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
দিলীপের সঙ্গে একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন গায়ত্রী। একসময় বন্ধু ছিলেন দিলীপ ও গায়ত্রী। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই সম্পর্কের অবনতি হয়। ২০১০ সালে আমেরিকায় একটি ট্যুরে যান ওই গায়ত্রী, দিলীপ এবং কয়েকজন অভিনেতা। সেখানে গিয়ে কাভিয়া নামক এক অভিনেত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান দিলীপ। যদিও ১৯৯৮ সালে অভিনেত্রী মঞ্জু ওয়ারিয়রের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন দিলীপ। ২০১২ সালে দিলীপের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু প্রমান পেয়ে যায় দিলীপের স্ত্রী মঞ্জু। এই নিয়ে গায়ত্রীকে প্রশ্ন করেন মঞ্জু। দিলীপের সম্পর্ক নিয়ে মঞ্জুকে সবকিছু বলে দেন গায়ত্রী। তারপর থেকেই গায়ত্রী ও দিলীপের বন্ধুত্বের সম্পর্কে চির ধরে। ২০১৩ সালে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় দিলীপ ও গায়ত্রীর। দিলীপের বিরুদ্ধে ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ মালায়ালম মুভি আর্টিস্টস’-এ অভিযোগ দায়ের করেন গায়ত্রী। দিলীপের জন্য মালায়লম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ তোলেন তিনি।
পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৩ সালে দিলীপ প্রথমবার গায়ত্রীকে হেনস্থার পরিকল্পনা করেন। অভিনেত্রীর এনগেজমেন্টের আগে অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সেই হেনস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হয়। ১০ জুলাই দিলীপকে গ্রেফতার করে কেরালা পুলিশ। ২০১৭ সালের অক্টোবরে জামিন পেয়ে যান দিলীপ। ২০ জানুয়ারি ২০২০ সালে মামলার ট্রায়াল শুরু হলেও ক্ষমতাশালী দিলীপকে কিছুই করা যায়নি। ২০১৭ সালে পরিচালক বালচন্দ্র কুমার একটি ভয়েস রেকর্ড প্রকাশ করে দাবি করেন, ২০১৭ সালের নভেম্বরে দিলীপের বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে গায়ত্রীকে যৌন হেনস্থার ভিডিও ক্লিপ দেখা হচ্ছিল। মামলার তদন্তকারী অফিসারকে খুনের পরিকল্পনাও চলছিল সেখানে।
২০১৭ সালে ১৯ মে ১৪ জন মহিলা কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের সঙ্গে দেখা করেন। মহিলাদের উপর হেনস্থা বন্ধের দাবি জানিয়ে একটি হলফনামা দেন তাঁরা। লিঙ্গ বৈষম্য বন্ধের আবেদন জানান। ওমেন ইন সিনেমা কালেক্টিভ নামে একটি ফাউন্ডেশন তৈরি করা হয়। এরপরই আভালকোপ্পাম অর্থাত উইথ হার ট্রেন্ড শুরু হতে থাকে। এর মাধ্যমে ২০১৭সালের নির্যাতিতা অভিনেত্রী গায়ত্রীর পাশে দাঁড়ান অনেকে। নিজেদের হেনস্থার কথাও শেয়ার করেন তাঁরা। মিটু আন্দোলনের অনেক আগে শুরু হয়েছে এই ট্রেন্ড। ওমেন ইন সিনেমা কালেক্টিভের সুপারিশ ও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদে চাপে পড়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে. হেমার নেতৃত্বে হেমা কমিটি গঠন করে বাম সরকার। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে লিঙ্গ বৈষম্য, মহিলাদের হেনস্থা সহ একাধিক বিষয়ে লড়াই শুরু হয়। ইন্ডাস্ট্রির ৪০ মহিলা হেমা কমিটির কাছে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা জানান। ২০১৯ সালে ৫হাজার পাতার একটি রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীকে জমা দেয় এই কমিটি। সুবিচার মিলবে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হলেও, সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনতে চায়নি কেরালা সরকার। নির্যাতিতা মহিলাদের পরিচয় প্রকাশ্যে চলে আসবে এই যুক্তি দেখিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের বিষয়টি এড়িয়ে যায় সরকার। তবে একাংশের মত এই রিপোর্ট সামনে এলেই বিপাকে পড়বেন ক্ষমতাশালীরা। এরপরও হার মানেনি কেরালার ফেমিনিস্ট গ্রুপ হার। ডব্লিউসিসিও হাল ছাড়েনি। হাইকোর্টেও মামলা করেন তারা। পশ অ্যাক্ট অনুযায়ী কেরালা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত সেটে ইন্টারনাল কমপ্লেন কমিটি স্থাপনের আবেদন জানানো হয়। ২০২২ সালের মার্চ তাতে সায় দেয় কেরালা হাইকোর্ট। ৬ জুলাই ২০২৪ সালে স্টেট ইনফরমেশন কমিশনার একটি অর্ডার পাশ করে, যাতে বলা হয়, কেরালা সরকারকে হেমা কমিটির রিপোর্ট আরটিআই আবেদনকারীদেরকে শেয়ার করতে হবে। তবে নির্যাতিতাদের পরিচয় গোপন রেখে প্রকাশ করা যাবে সেই রিপোর্ট। ১৯ অগাস্ট ২০২৪ সালে হেমা কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। ২৯০ পেজের মধ্যে ৪৫পেজ বাদ দিয়ে বাকি পেজ প্রকাশ করা হয়। সেই রিপোর্টে যৌন নির্যাতনের পাশাপাশি যে তথ্য সবাইকে চমকে দিয়েছে, তাত হল, ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় সুপারস্টারের আদেশেই যৌন হেনস্থার মতো ঘটনা ঘটছে। সব জেনেও কেউ কোনও পদক্ষেপ করেননি।
হেমা রিপোর্ট অনুযায়ী, বড় বড় অভিনেতা পরিচালকের মতো ১০-১৫জন দিলীপের সঙ্গী ছিল। যাদের নেতৃত্বে মালয়ালম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে মাফিয়ারাজ চালানো হত। যাদের কথা সায় না দিলেই কাজ হারাতে। অভিনেত্রী, পরিচালক, হেয়ার ড্রেসারের মতো সমস্ত স্তরের মহিলাদের শারীরিক সম্পর্কের জন্য জোর করা হত। যার পরই মিলত কাজ। যা ইন্ডাস্ট্রিতে অ্যাডজাস্টমেন্ট ও কম্প্রোমাইজ নামে পরিচিত। এখানেই শেষ নয় হেমা কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, ৮০শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে মিডনাইট নক অন দ্য ডোর হয়েছে। অর্থাত্ কাজ সেরে মহিলা যখন হোটেলে বিশ্রাম নিতে গিয়েছেন, তখন তাঁর ঘরে ঢোকার চেষ্টা, হুমকি এবং শারীরিক হেনস্থা করা হয়েছে। কাস্টিং কাউচের মতো ইস্যুও উঠে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব নিয়ে সরব হলেই বিভিন্ন ধরণের হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে মহিলাদের। অ্যাসোসিয়েশন অফ মালায়ালম মুভি আর্টিস্টস বিষয়টি জেনেও কোনও পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ। এবার বিষয়র তদন্তের জন্য সিট গঠন করেছে কেরালা সরকার। অভিযোগ সত্য হলে অভিযুক্তদের শাস্তির আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। তবে এই পুরুষতান্ত্রিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঘটে চলা যৌন হেনস্থার প্রতি আদৌ কোনও পদক্ষেপ করা হবে কিনা সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।