নারায়ণ দে, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স, ইন্ডিয়ান রেলওয়ের পর দেশের সবচেয়ে বেশি জমির মালিকানাধীন ওয়াকফের হাতে। রয়েছে ৯ লাখ একরেরও বেশি জমি। যার বেশিরভাগ অংশে রয়েছে কবরস্থান, ঈদগা, মসজিদ। কিছু দোকানপাট রয়েছে। এবং বৃহৎ অংশ জমি চাষাবাদের জন্য বরাদ্দ। এমনই ঘড়াপূর্ণ সংস্থায় লেগেছে খরা। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতির মুখে পড়া ওয়াকফ থেকে লাভ পেতে এবার সংশোধনী আনছে কেন্দ্র। যা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক।
৮ অগাস্ট, ২০২৪। সংসদীয় ও সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় দুটি বিল পেশ করেন। একটি ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪, অন্যটি মুসলিম ওয়াকফ রিপিল বিল ২০২৪। ওইদিনই বিলটি খতিয়ে দেখার জন্য একটি জয়েন্ট পার্লামেন্টরি কমিটি গঠন করা হয়। ২২ অগাস্ট কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। চতুর্থ বা শেষবার বৈঠকটি হয় ৬ সেপ্টেম্বর। পরবর্তী বৈঠক ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর।
যদি বিলটি পাশ হয়ে যায় তাহলে ১৯৯৫-এর ওয়াকফ আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যাবে। নাম বদলে হবে ইউনাইটেড ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট, এনপাওয়ারমেন্ট, এফিসিয়েন্সি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অ্যাক্ট অর্থাৎ উমীদ। কিন্তু ওয়াকফ বোর্ড আসলে কী? ওয়াকফ বোর্ডে ধারাবাহিক সমস্যা ও বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে কেন? সংশোধনী বিলে সব সমস্যার সমাধান হবে? যদি সমস্যার সমাধানই হবে তাহলে বিলটির বিরোধিতা করা হচ্ছে কেন?
ওয়াকফ বোর্ড কী? (What is Waqf ?)
কোনও ব্যক্তি তাঁর সারাজীবনে অর্জিত সম্পত্তি পারিবারিক স্বার্থের বাইরে গিয়ে সমাজের জন্য দান করবেন। আরও স্পষ্ট করে কোনও ধর্মীয় কারণে জমি ব্যবহার করতে চান। তাহলে তিনি ইসলামী নিয়মে নিজের সম্পত্তি ওয়াকফ করতে পারেন। অর্থাৎ দান। একবার জমি বা সম্পত্তি দান করলে তার মালিকানাধীন চলে যায় আল্লাহ বা ঈশ্বরের হাতে। ওয়াকিফ অর্থাৎ যিনি জমি দান করলেন, তার বা তার পরিবারের মালিকানাধীন সম্পূর্ণভাবে চলে যাবে ওই জমির ওপর থেকে। বরং ওই জমির দেখভাল করবে মুতাবলি বা ম্যানেজার। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থে ওই জমি ব্যবহার করতে পারবেন না। ব্যবহার করতে হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য বা ধর্মীয় কারণে।
ইংলিস ট্রাস্ট ল-এর সঙ্গে মিল
ইসলামিক ওয়াকফ আইন ইংলিস ট্রাস্ট ল-এর সঙ্গে অনেকাংশেই মিলে যায়। তবে অনেকগুলি পার্থক্যও আছে। যেমন ওয়াকফ হয় স্থায়ী অর্থাৎ পাকাপাকিভাবে। কিন্তু ট্রাস্টে তেমন নিয়ম নেই। ওয়াকফ শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণেই ব্যবহার করা যায়। ট্রাস্টের সম্পত্তি ব্যক্তিগত উন্নয়নেও ব্যবহার করা যায়। মূলত তিন ধরনের ওয়াকফ হয়। পাবলিক ওয়াকফ অর্থাৎ জনসাধারণের উন্নয়ন সাধনে সম্পত্তির ব্যবহার। খোয়াসি-পাবলিক ওয়াকফ অর্থাৎ সম্পত্তির একাংশ জনসাধারণের উন্নয়নে এবং অন্য অংশ গৃহহীন, অনাথদের উন্নয়নে ব্যবহার। এবং প্রাইভেট ওয়াকফ অর্থাৎ শুধুমাত্র গৃহহীন, অনাথদের উন্নয়নে ব্যবহার। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থে সম্পত্তির ব্যবহার হলেও তা দীর্ঘমেয়াদী নয়। আর এখানেই যাবতীয় বিতর্ক।
একাধারে চিন্তাবিদ, বিচারক ও সর্বোপরী পর্যটক ইবল বতুতা লিখে গিয়েছেন, ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার দামাস্কাসে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আনা হয়েছিল। যদি কোনও হোটেলে কোনও হোটেল কর্মীর অসাবধানতাবশত পোর্সেলিনের বাসন ভেঙে যায়, তাহলে ওই কর্মীকে জরিমানা করা হবে না। বরং ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে ওই ঘাটতি পূরণ করা হবে। যা থেকে বোঝা যায়, ওয়াকফের উদ্দেশ্য কিন্তু আগাগোড়াই সৎ। তবে আইন থাকলে আইনের ফাঁকও আছে। সবক্ষেত্রেই এই কথা যেন সমানভাবেই খাটে। ঠিক যেমন মহৎ উদ্দেশ্যে নিয়ে ওয়াকফ আইন তৈরি হলেও কোনায় কোনায় দুর্নীতি ঢুকে পড়তে বেশি সময় লাগেনি।
ভারতের ভুখণ্ডে ওয়াকফ নীতি ১০০ বছরেরও পুরনো। ১৯১৩-য় মুসলিম ওয়াকফ ভ্যালিডেটিং অ্যাক্ট তৈরি হয়। ১৯২৩-এ মুসলমান ওয়াকফ অ্যাক্ট তৈরি হয়েছিল। স্বাধীনতার পর সেন্ট্রাল ওয়াকফ অ্যাক্ট ১৯৫৪ আনা হয়। যার পরিবর্ত হিসাবে আনা হয়েছিল ওয়াকফ অ্যাক্ট ১৯৯৫। যে আইন মেনে এখনও পর্যন্ত কাজ করে আসছে ওয়াকফ বোর্ডগুলি। বর্তমানে দেশে মোট ৩২টি ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। প্রতিটি রাজ্যেই ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। আবার শিয়া ও সুন্নিদের জন্য পৃথক বোর্ডও রয়েছে। বোর্ডের কাজ রাজ্যে থাকা ওয়াকফ সম্পত্তি দেখভাল করা। সম্পত্তি থেকে আয় করা এবং আয়ের অর্থ ফের চ্যারিটেবল কাজে ব্যবহার করা। এর পাশাপাশি সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রকের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল রয়েছে। তাহলে সমস্যা কোথায়?
২০০৬-এ সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এই সরকারি রিপোর্টে ভারতের মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অবস্থা অধ্যয়ন করা হয়েছিল। ওই রিপোর্টেই একটা গোটা অধ্যায় রয়েছে ওয়াকফ নিয়ে। যেখানে বলা হয়েছিল, ওয়াকফের যা সম্পত্তি রয়েছে তার সঠিক ব্যবহার করলে বছরে খুব কম হলেও ১২ হাজার কোটি টাকা আয় হবে। অথচ ওই বছরেই ওয়াকফের আয় হয়েছিল মাত্র ১৬৩ কোটি টাকা। এত বড় ফারাক কীভাবে? বেশ কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে সাচার কমিটি কারণগুলি উল্লেখ করার চেষ্টা করেছে রিপোর্টে। প্রথমত, যারা মুতাবলি রয়েছেন অর্থাৎ ম্যানেজার। তারা ম্যানেজের চেয়ে বেশি দুর্নীতিতে মন দেয়। অনেক মুতাবলি ওয়াকফ সম্পত্তিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। যেমন নিজেই দোকান করে ফেলে অথবা দোকান বা বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পুরসভা ও পঞ্চায়েতও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে ব্যক্তি ওয়াকফ করছেন তিনি নিজেও দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলে যে পরিমাণ আয় হওয়ার কথা, তার সিকিভাগও আসছে না ওয়াকফের ভাণ্ডারে। এর জন্য একটি আলাদা কারণও দর্শানো হয়েছে রিপোর্টে।
সাচার কমিটির রিপোর্ট বলছে, ওয়াকফের স্বাভাবিক আয়ে কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সম্পত্তির ওপর দখলদারি। অনেক জায়গায় বেসরকারি সংস্থা বা ব্যক্তি, আবার অনেক জায়গায় সরকারই নিয়ম বহির্ভূতভাবে ওয়াকফের সম্পত্তি দখল করে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভাড়া দিলেও তা বাজারদরের থেকে অনেক কম। ওয়াকফের আয় কেন বাড়ছে না, তার একটা ধারণা মোটামুটি পাওয়া গেল। এবার দেখার বিষয়, এত অনিয়ম, দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও কেন সংশোধনী বিল নিয়ে আপত্তি তুলছেন মুসলিম সম্প্রদায়? বরং সমর্থন করাই তো উচিত। তাহলে কি ওয়াকফ বোর্ডগুলি মধ্যে আশঙ্কা সরকারি হস্তক্ষেপ নিয়ে? অতীতে দেখা গিয়েছে অনেক সাধারণ মানুষের জমি জোরপূর্বক ওয়াকফের বলে দাবি করা হয়েছে। আগামীতে এমন কিছু করা যাবে না, এই ভেবে কি শঙ্কিত?
ওয়াকফ আইন (WAQF Act) ১৯৯৫-এর ৪০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও সম্পত্তি নিয়ে সন্দেহ থাকে তাহলে ওয়াকফ বোর্ডের সদস্যরা নিজেরাই গিয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করতে পারবে সেই জায়গা। ৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, রাজ্য সরকার সার্ভে কমিশনারও পাঠাতে পারে। কমিশনার চাইলে সম্পত্তির দলিলও দেখতে পারেন। কিন্তু এখানে আরও বড় সমস্যা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাগজে-কলমে ওয়াকফ হয় না। হয় না সরকারি রেজিস্ট্রেশনও। ফলে কাগজ দেখে বোঝার উপায় নেই কোন জমি ওয়াকফের আর কোনটা নয়। ওয়াকফ আইন ১৯৯৫-এর ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডের সদস্যদের রাজ্য সরকারই মনোনীত করে। ফলে ওই বোর্ড কার্যত সরকারি নির্দেশেই চলে। আবার সার্ভে কমিশনারও রাজ্যই মনোনীত করে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের সদস্যদের মনোনীত করে কেন্দ্র সরকার। সকল প্রকার অভিযোগ শোনার জন্য রয়েছে সংসদীয় ট্রাইবুনাল। ট্রাইবুনালের সদস্যদেরও মনোনীত করে সরকার। ট্রাইবুনালের সিদ্ধান্ত সঠিক না হলে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করতে পারে। হাইকোর্ট চাইলে ট্রাইবুনালের নির্দেশ খারিজ পর্যন্ত করতে পারে।
এবার দেখা যাক সংশোধনী বিলে কী রয়েছে? কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে দুজন মুসলিম মহিলা বাধ্যতামূলক। যে প্রস্তাব ছিল সাচার কমিটিতে। একইসঙ্গে কাউন্সিলে দুজন অমুসলিম সদস্যও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদিও আগে এ নিয়ে কোনও নিষেধাজ্ঞা অবশ্য ছিল না। এই বিষয়গুলি নিয়ে অল্পবিস্তর বিতর্ক দানা বাধলেও সবচেয়ে বড় বিতর্ক হচ্ছে যে বিষয়টি নিয়ে, এবার সেই বিষয়ে আসা যাক। সংশোধনী বিল ১৯৯৫-এর ওয়াকফ আইনের ৪০ নম্বর ধারাটিই তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। যেখানে বলা আছে, সম্পত্তি নিয়ে সন্দেহ থাকলে ওয়াকফ বোর্ডের সদস্যরা নিজেরা গিয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করতে পারবে। পক্ষে সরকারের যুক্তি, এর ফলে জোরপূর্বক কারও জায়গা ওয়াকফ বোর্ড দখল করে নিতে পারবে না। তবে সংশোধনী বিল নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ, আইন সংশোধন করে আসলে সরকার জেলাশাসকদের হাতে যাবতীয় ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে। কারণ ওয়াকফ আইন ১৯৯৫-এর ৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী সরকার সার্ভে কমিশনার পরিদর্শনে পাঠাতে পারত। সংশোধনী বিলে ওই দায়িত্ব জেলাশাসকের ওপর দেওয়া হয়েছে। ফলে সংশোধনী বিল আইনে পরিণত হলে জেলাশাসক ঠিক করবেন কোন জমি ওয়াকফের আর কোনটি নয়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিলে বলা হয়েছে, ওয়াকফ সংশোধনী বিল আইনে পরিণত হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে সমস্ত জমির ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন করতে হবে ওয়াকফ বোর্ডগুলিকে। অন্যথায় ওয়াকফের ন্যায্য জমিও সরকারি খাস জমিতে পরিণত হবে।
ওয়াকফে স্বচ্ছতা আনতে বেশ কিছু প্রস্তাব রেখেছিল সাচার কমিটি। যেমন ওয়াকফ বোর্ডগুলি আরও শক্তিশালী করা, ট্রাইবুনালে দীর্ঘমেয়াদী জুডিশিয়াল অফিসার নিয়োগ করা, দখল জমি চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ করা। কিন্তু এগুলিকে পাত্তা না দিয়ে সাচার কমিটির রিপোর্ট থেকে বাছাই করা কিছু প্রস্তাব নিয়ে সংশোধনী বিল এনেছে কেন্দ্র। এখন দেখার জেপিসির পরবর্তী বৈঠকে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।