মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ১৯৯৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল জেমস ক্যামেরণ পরিচালিত টাইটানিক। রোম্যান্টিক অ্যাডভেঞ্চার টাইটানিকে নজর কেড়েছিল লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিয় এবং কেট উইন্সলেটের কেমিস্ট্রি। কিন্তু কীভাবে ডুবেছিল বিশালাকার এই টাইটানিক জাহাজ ? টাইটানিকের দুর্ঘটনার পিছনে কী কী কারণ উঠে এসেছে, জানতে চোখ রাখুন।
১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল, বিশ্বের ইতিহাসে বিখ্যাত বিশালাকার জাহাজ টাইটানিক সমুদ্রের অতলে ডুবে গিয়েছিল। প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। ১০০ বছর পার হয়ে গেলেও আজও রহস্যে মোড়া সেই টাইটানিক। যা নিয়ে মানুষের কৌতুহলের অন্ত নেই।
ব্রিটেন থেকে আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল জাহাজটির। ৮২২ ফুট ৯ ইঞ্চি দীর্ঘ এই জাহাজ তৈরি করতে প্রায় আড়াই বছর সময় লেগেছিল। সাড়ে ৩ হাজার যাত্রী ধারণের ক্ষমতা ছিল জাহাজটির। বেলফাস্টের একটি শিপইয়ার্ডে ১৯০৯ সালে টাইটানিকের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। যা মোটেও সহজ ছিল না।
বিশাল জাহাজটি নির্মাণের পর তা সমুদ্রে ভাসাতেও বেগ যথেষ্ট পেতে হয়েছিল। প্রচুর পরিমাণ তেল ব্যবহার করা হয়েছিল। মোট ২৩টন ডিজেল, মাছেল তেল ও তরল সাবান ব্যবহার করে জায়গাটি পিচ্ছিল করে টাইটানিককে জলে ভাসাতে সক্ষম হয়েছিলেন কর্মীরা। ৩০ লক্ষ লোহা ও স্টিলের গজাল ব্যবহার করা হয়েছিল টাইটানিকে। যা হাত দিয়ে লাগানো হয়েছিল। ওইসব গজালের ওজন ছিল প্রায় ১২০০ টন। বিশাল আকৃতির পাশাপাশি নিরাপত্তার দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছিল। ২ স্তর বিশিষ্ট টাইটানিকের হাল ১৬টি জল নিরোধক কম্পার্টমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। জাহাজটি যাতে কোনওদিন ভেঙে না পড়ে সেজন্য আড়াআড়িভাবে তৈরি হয়েছিল ১৫টি বাল্কহেড। পাশাপাশি এয়ার টাইট দরজার মাধ্যমে জাহাজের কম্পার্টমেন্টগুলি তৈরি করা হয়েছিল। সবদিক খেয়াল রাখা হলেও দূরবীন যন্ত্র নেওয়া হয়েছিল কিনা তা পরীক্ষা করতে ভুলে গিয়েছিলেন ক্রুরা। দূরবীন থাকলেও তা ব্যবহার করা যায়নি। অনেকের মতে ডেভিড ব্লেয়ার নামে একজন ক্রু দূরবীনের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁকে কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ৯ এপ্রিল কাজ থেকে বেরিয়ে যান তিনি। ভুল করে দূরবীন রাখা চাবিটাও ভুল করে নিয়ে যান ডেভিড ব্লেয়ার। আবার একাংশের মতে ডেভিডের কেবিনে ছিল দূরবীনগুলি। যা সঙ্গে করে নিয়েই জাহাজ ছাড়েন তিনি।
টাইটানিক বিশেষজ্ঞদের মতে, জাহাজ দুর্ঘটনার কবলে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল দূরবীনের ব্যবহার না করা।
১৯১২ সালে ১৪ এপ্রিল টাইটানিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। ওই সময় আইসবার্গ ছিল বলে রেডিও বার্তার মাধ্যমে টাইটানিককে বার্তা পাঠিয়েছিল অন্যান্য জাহাজ। কিন্তু সেই বার্তা উপেক্ষা করে টাইটানিক। কারণ সেই বার্তাগুলি টাইটানিকের নাবিকদের কাছেই পৌঁছয়নি। টাইটানিকের রেডিও অপারেটরদের নিয়োগ করেছিল মার্কনি কোম্পানি। তারা জাহাজের বিষয়ে তেমন ওয়াকিবহাল ছিল না। তাদের কাজ ছিল ধনী ব্যক্তিদের টেলিগ্রাম পাঠানো। সর্বশেষ সংবাদ সংগ্রহ করা, যা জাহাজের নিজস্ব সংবাদপত্রে ছাপানো হবে। তার আবহওয়া বা আইসবার্গ সংক্রান্ত তথ্যগুলি তারা নজর দেননি। তারা টেলিগ্রাম পাঠানোর ক্ষেত্রেই বেশি মনোনিবেশ করেছিল।
মিলা জিনকোভা নামে এক গবেষকের মতে, টাইটানিকের ডুবে যাওয়ার পেছনে সৌরঝড়েরও ভূমিকা রয়েছে।
সৌরঝড়ে সূর্যের উপরিভাগে তাপমাত্রা অনেকটা বেড়ে যায়, তার ফলে পৃথিবীর স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সৌরঝড় এবং জিওম্যাগনেটিক ঝড় টাইটানিকের নেভিগেশন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে দিয়েছিল। বিশেষ করে এই ঝড়ের জন্যই জাহাজের চৌম্বকীয় কম্পাস ঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। আর যার জন্য দিক ভুল করে টাইটানিক হিমশৈলে ধাক্কা মারে। অফিসিয়াল রিপোর্টে বলা হয়, জাহাজের কিছু নতুন কর্মীদের জন্যই টাইটানিক এই দুর্ঘটনার শিকার হয়। যিনি জাহাজের রেডিও যোগাযোগের দায়িত্বে ছিলেন তিনি অনিচ্ছাকৃত ভাবে সার্কিট নষ্ট করে ফেলেন। জিনকোভা অবশ্য জানিয়েছেন,সেইসময় জিওস্টর্ম নিয়ে সবে প্রাথমিক ধারণা গড়ে উঠছিল। যার ফলে জাহাজের ওই কর্মীদের পক্ষে সিগন্যাল এবং নেভিগেশনের অসুবিধাগুলো নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কিছু করা সম্ভব হয়নি।
শতাব্দী প্রাচীন টাইটানিক এবং সেই সম্পর্কিত জিনিসপত্র বহু মূল্যবান হয়ে ওঠে। টাইটানিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি অব্যাহৃত টিকিট লন্ডনের একটি নিলামে ৫৬ হাজার ৩০০ ডলারে বিক্রি হয়েছিল।টাইটানিকের একটি মেনুকার্ডে ৪০টি খাবারের নাম ছিল। যা নিউ ইয়র্কের একটি নিলামে ৩১ হাজার ৩০০ ডলারে বিক্রি হয়। আরেকটি মেনু লন্ডনে ৭৬ হাজার পাউন্ডে বিক্রি হয়। লাইভ বোটের একটি চাবি নিলামে ৫৯ হাজার পাউন্ডে বিক্রি হয়। এছাড়া টাইটানিক সম্পর্কিত বহু জিনিস চড়া দামে বিক্রি হয়েছিল।
৩.৭ কিলোমিটার গভীরে শায়িত রয়েছে টাইটানিক। বেশ কিছু অভিযান চালানো হয়েছে।
৯০-এর দশকে রাশিয়ার ডিপ সি সাবমার্সিবল মির ১ এবং মির ২-এর সফল অভিযানে টাইটানিকের বেশ কিছু ভিডিও নেওয়া হয়েছিল। ছবির পরিচালক নিজেও ১২বার ডাইভ দিয়ে টাইটানিকে পৌঁছে গিয়েছিলেন। বিশেষ আন্ডারওয়াটার ক্যামেরার মাধ্যমে টাইটানিকের ভিডিও নিয়েছিলেন তিনি। যা তাঁর ছবিতে ব্যবহার করা হয়।
বর্তমানে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ ইউনেস্কোর কালচারাল হেরিটেজ সাইট হিসেবে পরিচিত। দুর্ঘটনার ১০০ বছর পর এই সম্মাননা পায় টাইটানিক। তাই টাইটানিকের কোনও জিনিসই বর্তমানে সরানো বা নিয়ে আসাকে অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হয়। সবমিলিয়ে শতাব্দী পেরোলেও টাইটানিক নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। তা বলাই বাহুল্য।