সহেলি দত্ত, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ভারত শান্তিপ্রিয় দেশ। শত্রুকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া চলবে না। সদা সতর্ক থাকতে হবে সেনাবাহিনীকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এমনই কড়া নির্দেশ দিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর সেদেশে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ক্ষমতায় এসেছেন মহম্মদ ইউনুস। ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারকেও সহযোগিতা করবে বলে বার্তাও দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে দুই দেশ কতটা সহযোগিতা করে চলে তা সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে। অন্যদিকে অরুণাচলপ্রদেশের চিন সীমান্ত নিয়েও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতিতে ভারতীয় সেনার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের রাশিয়া ইউক্রেন, ইজরায়েল-হামাসের যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিতে বলেন রাজনাথ সিং। লখনউতে ‘সশক্ত ও সুরক্ষিত ভারত: দ্য ট্রান্সফর্মেশন অফ দ্য আর্মড ফোর্সেসের অনুষ্ঠানে সেনার জয়েন্ট কম্যান্ডারদের উদ্দেশে রাজনাথ সিং বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন, ইজ়রায়েল-হামাসের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশেও এখন স্থিতিশীলতা নেই। কাজেই আমাদের সবসময়ে সজাগ থাকতে হবে। আমরা শান্তিতেই আছি। তবে এই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে কী কী স্ট্র্যাটেজি নেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে প্রস্তুতিটা যেন সবসময় থাকে। বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের সীমান্তগুলিতে নজরদারি আরও জোরদার করার কথাও বলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, কাশ্মীর সীমান্ত সুরক্ষিত করতে গিয়ে জম্মু-সীমান্তের কিছুটা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। সেই সুযোগেই সেখানে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী সরাসরি এই প্রসঙ্গে কিছু না বললেও, এইসব ঘটনাকে মাথায় রেখেই সামরিক বাহিনীকে সজাগ থাকার কথা বলেছেন। আত্মনির্ভর ভারতের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বাহিনীতে আধুনিক অস্ত্র এবং প্রথাগত পুরনো অস্ত্র রাখার পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করার পরামর্শও দিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং।
সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণের আহ্বান জানিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ভবিষ্যতে ভারত কী কী ধরণের সমস্যায় পড়তে পারে তাও খতিয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি অপ্রত্যাশিত যেকোনও পরস্থিতি যাতে দ্রুত মোকাবিলা করা যায়, সেই বার্তাও দিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। বিশ্বজুড়ে শান্তি স্থাপনের পাশাপাশি ভারতেও শান্তি স্থাপন করার লক্ষ্যমাত্রা নিতে হবে। তাই যেকোনওভাবে যাতে মানুষের শান্তিভঙ্গ না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে বলে জানিয়েছেন রাজনাথ সিং।
ছাত্র আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশে যখন টালমাটাল অবস্থা তখন গত ৫ অগাস্ট বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। আগরতলা হয়ে নয়াদিল্লিতে চলে যায় তাঁর কপ্টার। অন্যদিকে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করে হাসিনাকে দেশেই রাখার সিদ্ধান্ত নেয় নরেন্দ্র মোদীর সরকার। আপাতত নয়াদিল্লির আশ্রয়েই রয়েছেন তিনি। শেখ হাসিনার আমলে ভারতের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বড় বড় প্রকল্প এবং চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল। কিন্তু হাসিনা সরকারের পতনের পর, এসব প্রকল্প কোন দিকে মোড় নেয় সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। এরইমধ্যে পিটিআইকে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনুস জানিয়েছেন, ভারতে বসে রাজনৈতিক মন্তব্য করছেন শেখ হাসিনা। যা মোটেও বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। ইউনুস আরও বলেন, শেখ হাসিনা ভারতে থাকায় কেউই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। হাসিনার বিচার করার জন্য তাঁকে বাংলাদেশে ফেরাতে চাই। তিনি ভারতে বসে রাজনৈতিক মন্তব্য করছেন। যা সমস্যা তৈরি করছে। ভারতে থাকলেও হাসিনা যদি চুপ থাকতেন তাও ঠিক ছিল। কিন্তু ভারতে থেকে তাঁর এই দিকনির্দেশ করাটা বাংলাদেশের মানুষ পছন্দ করছেন না। ইউনুস আরও বলেন, হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশের সমস্তটাই ইসলামি রাজনৈতিক শক্তি, এমন ভাবনা ছাড়তে হবে ভারতকে। ইউনুসের এই মন্তব্যের পাল্টা দিয়েছে নয়াদিল্লি। নয়াদিল্লির রণকৌশলগত বিশেষজ্ঞ মহলের বক্তব্য, অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক কাজকর্মে যে নকশা ফুটে উঠছে, তাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ‘মৌলবাদীদের নতুন স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপগুলি বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রাণ বিপন্ন করছে। পাশাপাশি বৃহত্তর আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত এবং বাংলাদেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেবে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।
এরইমধ্যে আবার সঠিকভাবে তিস্তার জলবন্টনের বার্তা দিয়েছেন মহম্মদ ইউনুস। একটি সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি অনুসারে তিস্তার জল ভাগ করতে হবে। ইউনুসের মন্তব্য, অনেকে মনে করেন তিস্তার জলের ভাগ নিয়ে আলোচনা মনমোহন সিংয়ের আমলে শুরু হয়েছিল। আসলে এই আলোচনা শুরু হয়েছে তারও অনেক আগে পাকিস্তানের শাসনকালে। এই বিষয়ে আলোচনাকে পিছিয়ে দেওয়াটাই হল ভারত সরকারের কৌশল। কিন্তু এই কৌশলে ভারত-বাংলাদেশ, কারোর
কোনও লাভ হচ্ছে না। সুতরাং, তিস্তার জলের ন্যায্য ভাগ চেয়ে ভারতের কাছে দরবার করে যাবেন বলে বার্তা দিয়েছেন মহম্মদ ইউনুস। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপ্রধান আরও জানান, আন্তর্জাতিক নিয়ম মানতে গিয়ে দেখা গেল, আমরা যে পরিমাণ জল পাচ্ছি, তা আমাদের মনমতো নয়। তা হলেও আমরা চুক্তিতে স্বাক্ষর করবো। কারণ দু’দেশের সম্পর্কের স্বার্থে তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে মতভেদের একটা মীমাংসা প্রয়োজন।
ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ঢাকা। এই পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সচেতন হোক। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ভাবে চাঙ্গা করতে অবিলম্বে নয়াদিল্লির সঙ্গে আলোচনা করুক। শ্রীলঙ্কাও এই ধরনের সঙ্কটে পড়েছিল। সেইসময় ভারত সর্বোতভাবে এবং একমাত্র দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভারতের প্রতি লক্ষ্যহীন ক্রোধ এবং অন্যায় বিরোধিতা করলে আখেরে তা ভারত-বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ককেই দুর্বল করে দেবে। বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের জন্য এই নীতি একেবারেই ভালো নয় বলে মনে করছেন কূটনীতিকদের একাংশ।