রিয়া দাস, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ জীবাশ্ব তেল আমদানির ক্ষেত্রে শীর্য তালিকায় বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে চিন। এই তেলের ৮০ শতাংশই পরিবাহিত হচ্ছে মালাক্কা প্রণালি দিয়ে। কারণ চিন সাগর থেকে স্বভাবতই ভারত মহাসাগরে আসতে হবে। চিনের জন্য মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প নেই। বিশ্বের সামুদ্রিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ দক্ষিণ-চিন সমুদ্র দিয়েই পরিচালিত হয় যার বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৫.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রায় এক লাখ জাহাজ পণ্য সরবরাহ করে ভারত মহাসাগর থেকে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের বাণিজ্য পথে যাতায়ত করে। যে কারণে মালাক্কা প্রণালীতে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখা চিনের নিজস্ব বাণিজ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু মালাক্কা প্রণালীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় চীন কখনোই খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। মালাক্কা প্রণালীর জন্য প্রান্তে রয়েছে দক্ষিণ চিন সাগর। চিন ও জাপান উভয়ের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই পথ। এছাড়া দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চরম বিরোধে জড়িয়েছে চিন। মালাক্কা প্রণালীর উত্তর পশ্চিমে ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের। স্বভাবতই ভারতের পাশ দিয়েই চলাচল করতে হয় চিনা জাহাজগুলোকে। এ কারণেই এলাকাটি নিয়ন্ত্রণের জন্য নজরদারি চালিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোয়াড গঠনের উদ্দেশ্যই ছিলো মালাক্কা প্রণালীতে চিনের আধিপত্য বিস্তার রোধ করা। ২০০৮ সালে সিঙ্গাপুরে তৈরি করা হয় কোয়াডের মূল ঘাঁটি এবং সেখানে মার্কিনঘাঁটিও তৈরি হয়। যে কারণে মালাক্কা প্রণালী নিয়ে চিনের জন্য উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়। তাই এই রুটের ওপর পথ খোলা ছিলো না চিনের সামনে। কিন্তু অনেকদিন ধরেই চিন তার বাণিজ্যের বড় অংশ করতে চাইছিলো বঙ্গোপসাগর উপকূল দিয়ে। বর্তমানে গোটা পৃথিবীর ও ক্ষমতার ভারসম্যের বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। ফুলে ফেঁপে উঠেছে চিন ও রাশিয়ার শক্তি। চিন-রাশিয়ার এই শক্তিবৃদ্ধি কিছুটা হলেও উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে ঘিরে সাম্প্রতিক আলোচনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলগত দৃষ্টিকোণ বলেই মনে করছেন একাংশ। থেকে বোধগম্য। মনে করা হচ্ছে, বিকশিত শক্তির গতিশীলতা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের প্রেক্ষাপটে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরে নতুন কোনো সামরিক ঘাঁটি বানাবে না। যদি ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি যদি সত্যি কোনও ইঙ্গিত হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ভারতের মতো আঞ্চলিক অংশীদারদের বঙ্গোপসাগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নেতৃত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা নেবে। যেখানে নজরদারি, ইন্টালিজেন্স ও জলপথ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে পেছন থেকে সাহায্য করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তবে বঙ্গোপসাগরে সামরিক ঘাঁটি না থাকলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও এই অঞ্চলে বাহিনী মোতায়েন করার ক্ষমতা ধরে রেখেছে। নতুন নৌ পথে আধিপত্য-স্থাপন করা শুধুমাত্র চিনের সঙ্গেই নয়, ভারতের মতো আঞ্চলিক অংশীদারদের ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ, মায়ানমার উভয় দেশের সঙ্গেই ভারতের সীমান্ত রয়েছে। এই দুই দেশই শক্তিশালী অংশীদার হলেও বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্মুখীন হচ্ছে। এই দেশগুলির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ আছে বলেই সমস্যা আরও গভীরে। বাংলাদেশ ও মায়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই অঞ্চল গুলোতে সামরিক সহায়তা করার উপযুক্ত সময় এখন নয়। বরং বঙ্গোপসাগর উভয় পাশের সুযোগ-সুবিধাগুলিকে কাজে লাগিয়ে ও ভারত মহাসাগরে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুমতি দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনকে আরও কিছুটা কোনঠাসা করতে পারবে। বঙ্গোপসাগর ঘিরে বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর আগ্রহ দিন বাড়ছে। যু্ক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিকে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, বিবেচনায় নিলে ভারত মহাসাগরের প্রেক্ষিতেই বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বেড়েছে অনেক। বিশেষ করে এই অঞ্চলে চিনের স্বার্থ ও উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ার কারণেই বঙ্গোপসাগরের জলপথ নিয়ে কৌশলগত গুরুত্ব অন্যদের কাছেও বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।