নারায়ণ দে, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ছাত্র-জনতার বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এবার সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পুলিশেও সংস্কার চাইছে সে দেশের জনগণ। হাসিনা সরকার পতনের পর পর সবচেয়ে বেশি পুলিশ ও পুলিশ থানাগুলির ওপর হামলা হয়েছে। এর কারণ হিসাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কোটা বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই পুলিশের গুলি চলেছে সাধারণ আন্দোলনকারীদের ওপর। একরকম শাসকদল আওয়ামী লিগের দলদাসে পরিণত হয়েই সাধারণ নাগরিকদের ওপর নির্বাচারে অত্যাচার করেছে পুলিশ। যার ফলস্বরূপ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিনই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লা আল মামুনকে। এখন তিনি রয়েছেন সেনা বাহিনীর হেফাজতে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন। কিন্তু শুধু মহাপরিদর্শক নয়, দেশ জুড়ে পুলিশে আমূল পরিবর্তন চাইছে বাংলাদেশিরা। মূলত, পুলিশে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে উদ্যোগী নতুন বাংলাদেশ। এর জন্য দ্রুত পুলিশ কমিশন গঠনের সুপারিশ উঠে আসছে সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মহম্মদ জাহাঙ্গির আলম চৌধুরীর ওপর ভরসা করতে পারছেন না সে দেশের বিশিষ্ট মানুষজনেরাই। কারণ তিনি পুলিশ সংস্কার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে সাহায্য চেয়েছেন। সেটাই ভালো চোখে দেখছেন না বিপ্লবীরা।
পুলিশে সমস্যা সমাধান করতে গেলে আগে জানা প্রয়োজন সমস্যা কোথায়? সার্বভৌমত্ব ধারণা তৈরি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার উদ্দেশ্য নিয়ে ব্রিটিশরা পুলিশ সার্ভিস চালু করেছিল। যে কারণে পুলিশের সামরিকীকরণ করা হয়। কিন্তু যেখানে অস্ত্রের ব্যবহার দুষ্কৃতী, অপরাধীদের বিরুদ্ধে করা উচিত। সেখানে দেশের জনগণের ওপর করা হলে কোনও নাগরিকই মেনে নেয় না। যে ছবি উঠে এসেছিল প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে। দেশের আইন মেনে নাগরিক অধিকার রক্ষা করাই পুলিশের প্রধান দায়িত্ব। যে ছবি উঠে আসছে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে। আরজি করের বিচার চেয়ে প্রতিদিনই নাগরিক সমাজ রাজ্যের কোনও কোনও রাস্তায় নামছে, মিছিল চলছে। স্লোগান উঠছে পুলিশের বিরুদ্ধে। অথচ প্রতিবাদীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দিকটা রাস্তায় নেমে সামলাচ্ছেন পুলিশকর্মীরাই। নাগরিক মিছিলে কোনও দুষ্কৃতী ঢুকে পড়লে তাকে চিহ্নিত করছে পুলিশই। বৃহত্তর স্বার্থে যানজট মুক্ত করতে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে দিলেও, আন্দোলনকারীদের ধর্না-অবস্থানে বিস্কুট, জল এগিয়ে দিচ্ছে পুলিশই। কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশের এই ভূমিকা দেখা যায়নি ওপার বাংলায়।
বাংলাদেশে শুরু থেকেই পুলিশ ঠিক পুলিশ নয়। প্যারা মিলিটারির পর্যায়ে রাখা হয়েছিল তাদের। যা গত ১৫ বছরে মিলিটারিতে পরিণত করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে ময়দানে নেমেছিল পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত অনেক পুলিশ। যারা পূর্ব পাকিস্তানের স্থানীয় বাসিন্দা ছিলেন। ১ হাজার ২৬২ জন পুলিশ মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধজয়ী পুলিশ কর্মী ও আধিকারিকদের নিয়েই বাংলাদেশ পুলিশ গঠিত হয়। পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা সামরিক বাহিনীর অনেক প্রাক্তন আধিকারিককে পুলিশের উচ্চ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশ পুলিশে নতুন নতুন বিভাগ যোগ হল। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ পুলিশে রেঞ্জ পুলিশ, মেট্রোপলিটন পুলিশ, আর্মড পুলিশ RAB-সহ প্রায় ১৮টি বিভাগ রয়েছে।
একাধিক বার বাংলাদেশ পুলিশের ইউনিফর্ম বদল হয়েছে। কিন্তু লোগোতে পরিবর্তন হয়নি। বর্তমানে পুলিশের ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তনের বিষয়ে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের লোগো থেকে বাদ যেতে পারে নৌকা, পরিবর্তে আসতে পারে দেশের মানচিত্র। পোশাকেও সবুজ রঙের প্রধান্য বাড়তে পারে। এরইমধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদ থেকে সরানো হয় সাখাওয়াত হোসেনকে। নতুন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা করা হয় মহম্মদ জাহাঙ্গির আলম চৌধুরীকে। তিনি দায়িত্বে এসে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে রেস্ট প্রথার বিলীন ঘটিয়েছেন। এবার পুলিশ সংস্কারে মন দিয়েছেন। এমন অবস্থায় প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন, পুলিশের সংস্কারে ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ-২০০৭’ প্রস্তাব করেছিল পুলিশ সদর দপ্তর। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারে এসে তা বাস্তবায়ন করেনি। বরং ওয়াহাবি ট্রায়াল-এর মতো হাসিনা সরকার পুলিশদের কুকর্ম করার জন্য পুরস্কৃত করে গিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশে সংস্কার করতে হলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও চাকরিচ্যুতি করা যাবে না। আর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি বলছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ, বদলি-সহ অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন করা দরকার। কমিশনে এমন বিধান রাখা উচিত যাতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে যদি অপেশাদারিত্বমূলক কোনও আদেশ দেওয়া হয়, গ্রাউন্ড জিরোয় পুলিশ যাতে সেটির প্রতিবাদ করতে পারে। পুলিশকে মানুষের বন্ধু হিসেবে, সহায়ক শক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এর জন্য পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র নয়, বরং শুধু আত্মরক্ষায় ব্যবহৃত অস্ত্রই দেওয়া হোক বলে সুপারিশ করছেন অনেকে। এ ছাড়া বর্তমানে পুলিশে যেসব দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা আছে তাঁদের দায়িত্ব দেওয়ারও আহ্বান জানান তাঁরা। সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রদের থেকে পুলিশে নিয়োগ করার সুপারিশও করা হয়েছে। এবং সমস্ত পরিকাঠামোটাই পশ্চিমের সাহায্য ছাড়াই তৈরি করতে হবে। আদতে কী হয়, কতদিনে হয়, পুলিশের সংস্কার আদৌও হয় কী না, পুলিশ-জনগণ সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কী না, তা জানতে নজর রাখুন আর প্লাস নিউজ ডিজিটালের বাংলাদেশ নিউজ আপডেটে।