নারায়ণ দে, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ৪ সেপ্টেম্বর, বুধবার। ওইদিন আবদুল্লাহিল আমান আজমি (Abdullahil Aman Azmi) বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবিতে সোচ্চার হন। তারপর থেকেই নতুন করে শুরু হয়েছে বিতর্ক। সমাজমাধ্যমে বাংলাদেশের নেটিজেনরা তার বক্তব্যকে সমর্থন করে একই দাবি তুলতে থাকে। পরিবর্তনের হিড়িকে তাহলে কি সত্যিই এবার পরিবর্তন হয়ে যাবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ কি তাহলে ইতিহাস হতে চলেছে ?
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি
গত ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পদত্যাগের পর বাংলাদেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। তারপর থেকে বাংলাদেশে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা যেন কিছুতেই স্থিমিত হওয়ার নাম নিচ্ছে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারত-বিরোধী, হিন্দু-বিরোধী মনোভাব ফুটে উঠছে বাংলাদেশে। এবার হিন্দু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত জাতীয় সঙ্গীতটিও ছেঁটে ফেলতে চাইছে সে দেশের মৌলবাদী শক্তি। সমাজমাধ্যমে রব উঠছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, একজন হিন্দু। ‘ঠাকুর’ পদবির একজন হিন্দুর লেখা গান কীভাবে একটা ইসলামিক দেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়?’ আবার কেউ লিখেছেন—‘বিধর্মী রবীন্দ্রনাথ ওই গানটি তাঁর আরাধ্যা মা কালীর ভজনায় লিখেছিলেন! সেই গান এখনই পরিবর্তন করা হোক! গানের মধ্যে বাংলাদেশ সংক্রান্ত একটি শব্দও নেই। সুরটিও নাকি বাউল গগন হরকরার একটি গান থেকে চুরি করা।’ তবে এই প্রথম নয়, সে দেশের ইসলামিক ‘হুজুররা’ বিভিন্ন ধর্মীয় জলসায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবিতে আগাগোড়াই সুর চড়িয়ে আসছেন। নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে আবদুল্লাহিল আমান আজমির মন্তব্যের পর। ছাত্রছাত্রীদের একাংশ এই দাবিতে ঢাকার রাস্তাতেও নেমেছে।
কে আবদুল্লাহিল আমান আজমি ?
গোলাম আজমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আজমি। গোলাম আজম কে ? লক্ষ মহিলাকে ধর্ষণ, খুনের মতো নারকীয় ঘটনার খলনায়ক। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্বে পাকসেনা বাহিনীকে সর্বান্তকরণে সাহায্য করতে ‘রাজাকার’ বাহিনী গড়েছিলেন যিনি, তিনিই জামাতের গোলাম আজম। প্রধান যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গোটা দেশে ঘৃণিত ছিলেন গোলাম। ৯০ বছরের কারাদণ্ডের সাজাভোগের সময় জেলেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। সেই গোলাম আজমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আজমি। তিনি আবার প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। তাঁরও অপকর্মের তালিকা কম ছিল না। যে কারণে ১৫ বছর আগে তাঁকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল। এই জাতীয় সঙ্গীত আমাদের স্বাধীনতার পরিপন্থী, আমান আজমির এই উক্তির পর থেকে বাংলাদেশীরা নতুন করে দু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে প্রতিবাদ
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি যখন জোড়ালো হচ্ছে। ঠিক তখনই এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বাংলাদেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও মুক্তমনা সাধারণ মানুষ। গত ৬ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ শুক্রবার গোটা বাংলাদেশজুড়ে ‘সমবেত কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত’ কর্মসূচি নিয়েছিল উদীচী, জাতীয় খেলাঘর ও আসরের মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামের মতো রাজনৈতিক দলগুলি থেকে কটাক্ষ ভেসে আসে, এই কর্মসূচি নাকি আসলে আওয়ামী লীগের। ঢাকার শহিদ মিনারে কর্মসূচির জন্য নির্ধারিত জায়গায় দুপুর থেকে মাদ্রাসার ছাত্ররা জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবিতে অবস্থান শুরু করে দেয়। নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কারণে কর্মসূচি বাতিল করে দেয় সেনা। কিন্তু পিছিয়ে না এসে ঢাকার একটি অডিটোরিয়ামে সমবেত কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত কর্মসূচি পালন করেছেন সাধারণ মানুষ। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই কর্মসূচি পালিত হয়। পাশাপাশি সমাজমাধ্যমেও সরব হয়েছেন কয়েকশো মানুষ। তাদের বক্তব্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানটিই তাদের সাহস জুগিয়েছিল। হাসিনার দল আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবুরের একার চেষ্টায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জয় আসেনি। একাত্তরে বাংলাদেশ গঠন করেছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। সে হিন্দুও হতে পারে, আবার মুসলমানও। প্রত্যেকের কাছেই অনুপ্রেরণা ছিল আমার সোনার বাংলা গানটি।
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির ইতিহাস
রবিঠাকুরের সোনার বাংলা গানটি কীভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেল ? জানতে হলে একটু ইতিহাসে নজর রাখতে হবে। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে গানটি রচনা করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্যেন রায়ের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯০৫-এর ৭ অগাস্ট কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের একটি প্রতিবাদ সভায় প্রথমবার সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয় ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। ওইবছরই ৭ সেপ্টেম্বর সঞ্জীবনী পত্রিকায় গানটি ছাপা হয়। তারপর থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই গান বাংলার মানুষের আন্দোলনের গান হয়ে উঠেছিল। এমনকী দেশভাগের পরও এই গানটি দুই-বাংলাতেই সমমর্যাদা পেয়ে এসেছে।
১৯৭০-এ মুক্তি পাওয়া বিখ্যাত পরিচালক জহির রায়দানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ছবিতে এই গান ব্যবহার করা হয়েছিল। এই ছবিতে তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আবহে যখন উত্তাল পূর্ব পাকিস্তান, এমন সময় ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক জনসভায় গানটি গাওয়া হয়েছিল। ওইবছরেরই ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান তথা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা করেছিলেন। ওই সমাবেশেও ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গেয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল বাঙালি। এর দু সপ্তাহ পর ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্যারেডেও গানটি পরিবেশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল জনগণের রায়ে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা তৎকালীন বৈদ্যনাথতলা তথা আজকের মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করেন। ওই সরকারই প্রথমবারের জন্য ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেয়। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্বুদ্ধ করতে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হত। স্বাধীন বাংলা বেতারের তৎকালীন সুরকার অজিত রায় যে যন্ত্রসঙ্গীতে গানটিকে বেঁধেছিলেন আজও সেই সুরেই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-এ গানটিকে সাংবিধানিক ভাবে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ৪ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ‘আমার সোনার বাংলা’-র প্রথম ১০টি চরণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
‘আমার সোনার বাংলা’-র বিশ্বরেকর্ড
বাংলাদেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের মতে, যারা জাতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস জানে না, যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী শক্তি হিসাবে কাজ করেছে আজ তারাই জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি তুলছে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গোটা বিশ্বে বন্দিত। শুধু কী তাই, ২০১৪-র ২৬ মার্চ ঢাকার জাতীয় প্যারেড ময়দানে একসঙ্গে ২ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে গিনেস অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে বাংলাদেশের নাম নথিভুক্ত করেছিল। গায়ে কাটা দেওয়া সেই জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের কোনও অর্থই হয় না।
বিতর্কের পথে যাবে না অন্তর্বর্তী সরকার
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের হিড়িক তুলে সমাজমাধ্যমে ভারত বিরোধী মনোভাব আরও জোড়ালো করতে চাইছে একদল বাংলাদেশী। উগ্র ভারত বিরোধিতার এই পর্বে নেটিজেনদের সেই চাপকে উপেক্ষা করতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকারও। অন্যদিকে বিরোধিতা করে পাল্টা প্রচারও চলছে। এমতাবস্থায় রাজশাহী বিভাগীয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিদর্শনে যান অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা খালিদ হোসেন। সেখানে ইসলাম, সনাতন, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী এবং সুধীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়ের প্রাক মুহূর্তে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি জানান, ‘জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস চলছে। আমাদের প্রধান উপদেষ্টাও বার বার বলেছেন, বিতর্ক সৃষ্টি হয় এমন কোনও কাজ আমরা করব না।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের চেষ্টা এবারও ব্যর্থ।