পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশের বিদ্যুত্ ব্য়বস্থায় শকের পর এবার ঝটকা লাগল টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে। পোশাক শিল্পে প্রবল অস্থিরতা। অর্থনীতিতে অশনি সংকেত দেখছে ইউনুস সরকার।
হাসিনা বিদায়ের ঢেউ পোশাক শিল্পে ?
কোটা বিরোধী আন্দোলনের জেরে ৫ অগাস্ট পদ ও দেশ ছাড়েন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু বাংলাদেশকে ফেলে দেন মহা বিপাকে। হাসিনার পর অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. মহম্মদ ইউনুস। তাঁর সরকার গঠনের পরই বিগত ১৬ বছরের নানা অনিয়ম ও অ-ব্যবস্থাপনার প্রতিকার চাইতে ফুঁসে ওঠেন নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ। যার বড় ঢেউ লাগে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে।
বিশ্ববাজারে পোশাক ধাক্কা
এশিয়ার অর্থনৈতিক উত্থানের পিছনে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এশিয়ার প্রায় সব দেশই বিশ্ববাজারের জন্য পোশাক উৎপাদন করে হাজার হাজার কোটি ডলার আয় করেছে। তবে এই শিল্প যে কতটা শক্তিশালী হতে পারে, তা বাংলাদেশের উত্পাদন ক্ষমতা না দেখলে বোঝা যায় না। পোশাক শিল্পের বিশ্বায়নে বাংলাদেশকে এতদিন বিরল নজির বলেই মানা হত। কিন্তু হাসিনা দেশ থেকে মুখ ফেরাতেই যেন বিরাট ধাক্কা খেল বাংলাদেশের পোশাক শিল্প। এর পিছনে রয়েছে মূল তিনটি কারণ- ১. রাজনৈতিক অস্থিরতা, ২. বন্যা পরিস্থিতি, ৩. অপ্রতুল জ্বালানি। বাংলাদেশে ক্ষমতার পালা বদলের পর দেশের তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করেছে বকেয়া বেতনের জন্য।
একের পর এক ঝটকা
ভারতীয় শিল্পপতি গৌতম আদানির কাছে বিদ্যুত্ কেনাবেচায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার দেনায় ডুবে থাকার কথা আগেই প্রকাশ পেয়েছে। যার ফল দেশজুড়ে বিদ্যুত্-বিভ্রাট। এছাড়াও গ্যাস সংকটের কারণে ব্যাহত হয়েছে শিল্পোত্পাদনও। এবার ধাক্কা খেল বাংলাদেশের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি। রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে বন্ধ গয়ে গিয়েছে ৭০০ থেকে ১০০০ ছোট ও মাঝারি সাইজের গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল ইউনিট।
পোশাক শিল্পে অস্থিরতা, বন্ধ কারখানা
শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে কার্যত অচল হয়ে পড়ছে পোশাকশিল্প। বেতন বৃদ্ধিসহ নানা দাবিতে প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষ চলছেই। এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে রাজনীতিও। এ সংকট দ্রুত শক্তভাবে প্রতিহত করতে না পারলে দেশের পুরো পোশাক শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বিরূপ পরিস্থিতির জেরে আশুলিয়া, সাভার ও টঙ্গীতে কার্যত অনেক কারখানা বন্ধ।
অর্থনীতির শক্তিকেন্দ্র থেকে পতন
১৯৭৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার এক কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে প্রথম রফতানিমুখী পোশাক কারখানা তৈরি করে বাংলাদেশ। এরপর পোশাক রফতানি বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হয়। দেশটির তৈরি পোশাক খাতে ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষ কাজ করেন। দেশের জিডিপিতে এই খাতের অবদান ১০ শতাংশ। গত বছর বাংলাদেশ ৫৪ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। এ ক্ষেত্রে চিনের পরেই অবস্থান ছিল বাংলাদেশের। সাম্প্রতিক অস্থিরতার জেরে সেই শক্তির তকমার পতন ঘটেছে। সামগ্রিকভাবে চলতি বছর পোশাক রফতানি ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমবে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে ভারত ?
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, বাংলাদেশের দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাইছে বিশ্বের অন্যান্য দেশ। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের নামও। বাংলাদেশে অস্থির পরিস্থিতির জেরে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে চলেছে ভারত। যার মধ্যে উত্তরপ্রদেশ এই সুযোগ সবচেয়ে বেশি পাচ্ছে বলেই খবর। যোগী রাজ্যের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে ইতিমধ্যেই ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রসঙ্গ উথ্থাপন হয়ে গিয়েছে। ত্রিপুরার রাজ্যের কয়েকটি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, বাংলাদেশে অস্থিরতার কারণে তারা নতুন করে ৫৪ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার পেয়েছে। নয়াদিল্লির বাইরের আরেকটি গ্রুপ জানিয়েছে, গত আগস্টে তারা সনামধন্য এক স্প্যানিশ ফ্যাশন ফার্ম কাছ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি অর্ডার পেয়েছে।
সুতো উত্পাদনে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হলেও তৈরি পোশাক উত্পাদনে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশের থেকে। ২০২৩ সালেই ভারত বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ পোশাক রফতানি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর থেকেই একের পর এক পোশাক তৈরির বরাত হাতছাড়া হচ্ছে। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকে সেইসব পোশাক তৈরির বরাত দিচ্ছে আন্তর্জাতিক পোশাকের ব্র্যান্ডগুলি।
আশা জাগানো দাবি
যদিও একাংশের দাবি, প্রতিযোগীদের তুলনায় বাংলাদেশের বড় কিছু সুবিধা আছে। যেমন, বাংলাদেশের শ্রম ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। এ ছাড়া ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ এখনও অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা পায়, যা ভারত পায় না।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের মতে, চিনের স্বল্পমূল্যে পোশাক উৎপাদন কমে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। তবে এক্ষেত্রে সরবরাহ ব্যবস্থার ওপরের দিকে যেতে হলে কাজের মান বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে পোশাক উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন বিদেশি ক্রেতারা। দিচ্ছেন না নতুন অর্ডার। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ মুখ থুবড়ে পড়েছে। কবে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে ফের অর্থনীতির শক্তিকেন্দ্র পরিনত হতে পারবে বাংলাদেশ। সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।