মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ৫জুন ২০২৪. সকাল ১০.৫২ মিনিটে আমেরিকায় স্টারলাইনার স্পেস ক্র্যাফট মহাকাশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। তাতে ছিলেন নাসার দুই দক্ষ মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস এবং ব্যারি বুচ উইলমোর। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের একটি ছোট ট্রিপে যাওয়ার কথা ছিল তাঁদের। মাত্র ৮দিনের সফরের কথা ছিল। কিন্তু ৩মাস কেটে গেলেও এখনও মহাকাশেই আটকে এই দুই মহাকাশচারী।
স্টারলাইনার নামে একটি স্পেসক্র্যাফ্টে করে তাঁরা মহাকাশে গিয়েছিলেন। এটি একটি প্রাইভেট কোম্পানির বানানো স্পেসক্র্যাফ্ট। সংস্থাটি এরোপ্লেনও বানায়। যাদের একাধিক বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। স্টারলাইনার স্পেসক্র্যাফ্ট নিয়ে এখনও কাজ চলছে। কীভাবে এটি আরও উন্নত করা যায়, তা খতিয়ে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বোয়িং স্টারলাইনারের দক্ষতা খতিয়ে দেখার জন্যই এই স্পেস ট্রিপের আয়োজন করা হয়েছিল। সেজন্য এই মিশনের নাম রাখা হয়েছিল বোয়িং ক্রু ফ্লাইট টেস্ট। প্রায় ২৭ঘণ্টা সফরের পর ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে পৌঁছে যায় মহাকাশযানটি। এরপরই হিউম্যান অরবিটাল স্পেসক্র্যাফ্ট তৈরি এবং মহাকাশে পাঠানোর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে নিল বোয়িং স্টারলাইনার। এর আগে স্পেস এক্স এধরণের কাজ করেছিল।
৮দিন পর পৃথিবীতে ফেরার কথা ছিল ওই দুই মহাকাশচারীর। কিন্তু ৩মাস কেটে গেলেও এই দুই মহাকাশচারী মহাকাশেই ফেঁসে রয়েছেন। নাসার বক্তব্য অনুযায়ী, ৮মাস ওখানেই থাকতে হবে তাঁদের। বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে স্পেসক্র্যাফ্টে। কীভাবে হল এমন বিপর্যয়, বোয়িং কোম্পানি এখানে কতটা দোষ রয়েছে, চলুন দেখে নিই।
দুজন মহাকাশচারী ফেঁসে থাকলেও কোনও শারীরিক সমস্যা নেই তাঁদের মধ্যে। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন ৩৫০ ফুটেরও বেশি দীর্ঘ। লিভিং এবং ওয়ার্কিং রুমটি ৬ বেডরুমওয়ালা ঘরের চেয়েও বেশি বড়। ৬জনের শোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। এছাড়াও তাঁদের খাওয়া-দাওয়া, পানীয়, টয়েলেট, পোশাক, অক্সিজেনের যথাযথ ব্যবস্থা রয়েছে। দুটি বাথরুম, একটি জিম এবং ৩৬০ডিগ্রি দেখা যায় এমন একটি জানালাও রয়েছে। লাক্সারি হোটেল না হলেও জীবনধারণ ভালোভাবেই করা যায় সেখানে।
ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে তাদের নিজেদের একটি অক্সিজেন জেনারেটিং সিস্টেমও রয়েছে। যা জলের মধ্যে থাকা ইলেক্ট্রোলিসিস থেকে অক্সিজেন তৈরি করে। পাশাপাশি অক্সিজেনকে রিসাইকেলও করে। আমরা যখন শ্বাস ছাড়ি তখন তার মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেশি থাকে। তবে সামান্য পরিমাণ অক্সিজেনও থাকে। ওই সামান্য পরিমাণ অক্সিজেনকে সংগ্রহ করে আবার তাকে কাজে লাগায় এই মেশিন। এমনই জলের রিসাইকেল সিস্টেমও রয়েছে ওই স্পেস স্টেশনে। সেখানে ইউরিনকে রিসাইকেল করে পানীয় জল তৈরিক রা হয়। ঘাম বা শ্বাসত্যাগ করার সময় তাতে যে আর্দ্রতা থাকে, তাকেও ক্যাপচার করে নেয় এই মেশিন।
৬মাসের খাবার মজুত থাকে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে। ৫-৬মাস করে মহাকাশচারীরা সেখানে থাকেন। সুনীতা উইলিয়ামস ও ব্যারি বুচ যখন সেখানে পৌঁছন, সেখানে আরও ৭জন উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন নাসার ৪জন মহাকাশচারী- ম্যাথিউ ডমিনিক, মাইক বারাট, জনেট অ্যাপস এবং ট্রেসি সি ডাইসন। এছাড়া রাশিয়ার স্পেস এজেন্সি রসকসমসের ৩জন মহাকাশচারী উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তাঁরা হলেন ওলেক কনোনেনকো, নিকোলাই চব এবং অ্যালেকজান্ডার গ্রেবেনকিন। মূলত প্রত্যেকটা মহাকাশ অভিযানে ৬ থেকে ৭জন করে সদস্য থাকেন। এই অভিযান ২৪ বছর ধরে চলছে। ২০০০ সালে প্রথমবার মহাকাশে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনকে লঞ্চ করা হয়েছিল। সেসময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত স্পেস স্টেশনকে কখনও দীর্ঘ সময়ের জন্য ফাঁকা রাখা হয়নি। কোনও না কোনও দেশের মহাকাশচারীরা সেখানে থেকেছেন।
এক্সপেডিশন ৭১, ২০২৪-এর ২৪ সেপ্টেম্বরে শেষ হবে। এই অভিযানে যাওয়া মহাকাশচারীরা ওই সময় পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। তারপর ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে তাঁদের জায়গায় পৌঁছবেন এক্সপেডিশন ৭২-এর সদস্যরা। তাঁরা আরও অনেক খাদ্যাসামগ্রী নিয়ে যেতে পারবেন দুই মহাকাশচারীর জন্য। এক্সপেডিশন ৭১ এবং ৭২-র অংশ হয়ে গিয়েছেন সুনীতা ও ব্যারি। সকলে মিলে একাধিক গবেষণা করছেন। যেমন এক্সপেডিশন ৭১-এর সদস্যরা স্পেস বোটানি নিয়ে গবেষণা করছেন। মহাকাশে কীভাবে ফুল ফোটানো যায়, নিউরো-ডিজেনারেটিভ ডিজিজ ও রোগমুক্তি সহ একাধিক বিষয়ে গবেষণা করছেন তাঁরা। ব্যারি ও সুনীতা দুজনেই খুব দক্ষ মহাকাশচারী। বছর ৬১-র ব্যারি বুচ বর্তমান অভিযানের আগে ইতিমধ্যে ১৭৮দিন মহাকাশে কাটিয়ে ফেলেছেন। সুনীতা উইলিয়ামস কল্পনা চাওলার মতোই ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহাকাশচারী। কিন্তু সুনীতা উইলিয়ামস আমেরিকাতেই জন্মগ্রহণ করেছেন। বছর ৫৮-র সুনীতা উইলিয়ামস বর্তমান অভিযানের আগে ৩২২দিন মহাকাশে কাটিয়েছেন। এর আগে এক্সপেডিশন ১৪,১৫,৩২,৩৩-এর অংশ ছিলেন সুনীতা উইলিয়ামস। এক্সপেডিশন- ৩৩-এর কম্যান্ডারও ছিলেন সুনীতা। সুতরাং মহাকাশে ফেঁসে যাওয়া এই দুই মহাকাশচারীর কোনও সমস্যা হচ্ছে না। কারণ আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে খাবার, পানীয় জল, অক্সিজেন সবকিছুরই ব্যবস্থা রয়েছে। তবে পোশাকের খানিকটা সমস্যা ছিল। কারণ মাত্র ৮দিনের পোশাক সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন সুনীতা ও ব্যারি। পরে তাঁদের ব্যক্তিগত জিনিসের জন্য ৬ অগাস্ট একটি শিপমেন্ট পাঠিয়েছিল নাসা।
এবার আসা যাক মূল সমস্যায়। বোয়িংয়ের এই স্টারলাইনার স্পেসক্র্যাফ্ট একটি অরবিটাল স্পেসক্র্যাফ্ট। যার পুরো নাম ক্রুস স্পেস ট্রান্সপোর্টেশন ১০০ স্টারলাইনার। স্পেস এক্সের পর বোয়িং একমাত্র প্রাইভেট কোম্পানি যেটা একটি অরবিটাল স্পেস ক্র্যাফ্টকে স্পেস স্টেশনে পাঠিয়েছে।
অরবিটাল স্পেস ক্র্যাফ্ট প্রচণ্ড গতিবেগে উপরে উঠে পৃথিবীর গতিপথে পৌঁছে যায়। তারপর পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। এরজন্য ২৮হাজার কিলোমিটার প্রতিঘণ্টা গতিবেগ থাকতে হয়। চিন , রাশিয়া, আমেরিকাও এধরণের কাজ করেছে। ভারত এখনও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের আগামী গগণযান মিশনেও অরবিটাল স্পেসক্র্যাফ্টকে মহাকাশে পাঠানো হবে। তবে তাতে কোনও মানুষ থাকবেন না। তাতে থাকবে একটি রোবোট। যার নাম রাখা হয়েছে ভিওমিত্র। নাসা ২০১১ সালে কমার্শিয়াল ক্রু প্রোগ্রাম শুরু করেছিল। সেসময় প্রাইভেট কোম্পানির সঙ্গে হাত মেলায় নাসা। ব্লু অরিজিন, সিয়েরা নেভারা সহ একাধিক কোম্পানি নিলামে অংশ নেয়। ২০১৪ সালে স্পেস এক্স এবং বোয়িংকে বেছে নেওয়া হয় অভিযানের জন্য। ২০২০ সালের নভেম্বরে স্পেস এক্স ক্রু-১ ফ্লাইট লঞ্চ করা হয়। সফল হয়েছিল অভিযানটি। এদের স্পেস ক্র্যাফ্ট ছিল ক্রু ড্রাগন। যার সঙ্গে বোয়িং স্টারলাইনের একাধিক সামঞ্জস্য আছে।
বোয়িং স্টারলাইনার লঞ্চ করা হয় ৫জুন। তার আগে ৬মেতেও স্টারলাইনার লঞ্চের কথা ছিল। কিন্তু সমস্যার কারণে কাউন্টডাউন বন্ধ করে দেওয়া হয়। অ্যাটলাস ফাইভ রকেটের সঙ্গে স্পেসক্র্যাফ্টটি যুক্ত থাকে। যার উপরে একটি প্রেশার ভালভে সমস্যা থাকায় সেসময় অভিযান স্থগিত করা হয়েছিল।
পয়লা জুন আবারও স্টারলাইনার লঞ্চ থামাতে হয়। লঞ্চের ৪মিনিট আগে অভিযান বাতিল করা হয়। কম্পিউটার অ্যাবর্ট সিস্টেমের মাধ্যমে সমস্যাটি নজরে আসে। ৫জুন স্টারলাইনের লঞ্চের আগেও নাসা এবং বোয়িংয়ের ইঞ্জিনিয়াররা হিলিয়াম লিক সারাইয়ের কাজ করেছিলেন।
হিলিয়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্যাস। যা স্টারলাইনারের থ্রাস্টারে ফায়ার করে। স্পেসক্র্যাফ্টটি যখন ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেসময় ডক এবং আনডক করার ক্ষেত্রেও থ্রাস্টারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এই থ্রাস্টারকে চালানোর জন্যই প্রয়োজন হিলিয়াম গ্যাস।
সেসময় নাসা এবং বোয়িংয়ের ইঞ্জিনিয়াররা জানিয়েছিলেন, এটা বড়সড় সমস্যা নয়। একটি ত্রুটিপূর্ণ সিলের কারণে হিলিয়াম লিক হয়েছে। সেজন্যই ৫জুন এটি লঞ্চ করা হয়। কিন্তু লঞ্চের পর আরও ২টি লিক নজরে আসে। স্টারলাইনার স্পেস স্টেশনে পৌঁছনোর পর চতুর্থ হিলিয়াম লিক নজরে আসে মহাকাশচারীদের। ৪টি লিক প্রকাশ্যে আসার পর বোয়িংয়ের কমার্শিয়াল ক্রু প্রোগ্রাম ম্যানেজার জানান যে, কী সমস্যা হয়েছে তা পরিষ্কার নয়। মূল সমস্যাটাকে খতিয়ে দেখতে হবে।
আরও সমস্যা উঠে আসে। তা হল- স্টারলাইনারে লাগানো ২৮টি থ্রাস্টারের মধ্যে ৫টি কাজ করে না। সেজন্য ম্যানুয়াল কন্ট্রোল নিজের হাতে নিতে হয় ব্যারি বুচকে। রিসেট করে দ্বিতীয়বার ফায়ার করায়, ৫টির মধ্যে ৪টি থ্রাস্টার কাজ করতে শুরু করে এবং সাফল্যের সঙ্গে এটি ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে ডক করে। ঘটনায় নাসা ও বোয়িংয়ের ভূমিকায় একাধিক প্রশ্ন উঠে যায়।
৬জুনের পরে নাসা ও বোয়িং থ্রাস্টারগুলির হট ফায়ার টেস্ট করে। থ্রাস্টারগুলি অত্যাধিক গরম হয়ে যাওয়ার কারণে কাজ করছে না বলে জানা যায়। ক্যাপসুলের ম্যানুয়াল কন্ট্রোল সিস্টেমে সরাসরি সূর্যের আলো পড়ায় এটি অত্যধিক গরম হয়ে যাচ্ছে বলে উঠে আসে পরীক্ষায়। থ্রাস্টারগুলিকে সূর্যের রশ্মি থেকে দূরে পরীক্ষা করলে তা ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে শুরু করে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়াররা জানতেন না যে স্টারলাইনার যখন ফিরবে এর মধ্যে ওভারহিটিংয়ের সমস্যা হবে কিনা। সেজন্য মহাকাশচারীদের স্পেস স্টেশনে রেখেই স্টারলাইনার ফিরবে। এক্ষেত্রে মহাকাশচারীদের নিরাপত্তায় গুরুত্ব দিয়েছে নাসা। না হলে ২০০৩ সালের বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি হত। সেসময় পৃথিবীতে ফেরার সময় কল্পনা চাওলার স্পেস ক্র্যাফ্টে বিস্ফোরণ হয়েছিল।
আগামীদিনে সুনীতা ও ব্যারিকে পৃথিবীতে ফেরানোর জন্য স্পেস এক্সের ক্রু ড্রাগন স্পেস ক্র্যাফ্টকে কাজে লাগানো হবে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্পেস এক্সের ক্রু-৯ মিশন যখন ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে পৌঁছবে, ওই মিশনে ৪ জনের পরিবর্তে ২জন মহাকাশচারীকে পাঠানো হবে। যাতে সুনীতা ও ব্যারি তাঁদের সঙ্গে ফিরে আসতে পারেন। অর্থাৎ আরও ৯মাস সুনীতা ও ব্যারি বুচকে মহাকাশেই কাটাতে হবে।