পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ১৭ সেপ্টেম্বর একসঙ্গে ৩০০০ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে লেবানন। দিকে দিকে ছিন্ন ভিন্ন দেহ, মৃত্যুমিছিল। আহত কমপক্ষে ৪০০০। কাঠগড়ায় ইজরায়েলের মোসাদ। হত্যার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে পেজার।
তবে এই পেজার কি ?
এ যুগের অনেকেই জানেন না পেজার জিনিসটা ঠিক কী ? তা জানতে হলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে প্রায় দুই দশক আগে। সকলের হাতে তখনও ওঠেনি মুঠোফোন। সে সময় তত্ক্ষণাত্ যোগাযোগের উল্লেখযোগ্য মাধ্যম ছিল পেজার। এই পেজারের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বার্তা পৌঁছে দেওয়া হত এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। পেজার হাতে বা পকেটে নিয়েই ঘোরা যায়। এবার সেই অ্যান্টিক গ্যাজেট ব্যবহার করেই লেবাননে চলল নিধনযজ্ঞ।
কী ঘটেছিল সেদিন ?
ইরান সমর্থিত সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী হেজবোল্লার সদস্যরা গুপ্ত কথোপকথনের মাধ্যম হিসেবে এখনও পেজার ব্যবহার করে। কারণে পেজারে লোকেশন ট্র্যাক করা যায় না। মঙ্গলবার একসঙ্গে ৩০০০ পেজারে বিস্ফোরণ ঘটে। এই ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে গোটা বিশ্বে। এই হামলায় ইজরায়েলে মোতায়েন থাকা ইরানের রাষ্ট্রদূত মোদতবা আমানিও আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এক হেজবুল্লা সাংসদের ২ ছেলে এবং ইরান সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী সদস্যের ১০ বছরের কন্যাও রয়েছে। পাশাপাশি, সিরিয়াতেও পেজার বিস্ফোরণে ১৪ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। সেখানে পেজার ব্যবহার করে একটি গাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। বিস্ফোরণের ফলে মুখ, হাত এবং পেটে হয়েছে গভীর ক্ষত। হাসপাতালগুলিতে তিল ধারণের জায়গা নেই। চারপাশে শুধুই হাহাকার। এই পরিস্থিতিতে ইজরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে হেজবোল্লা একটি বিবৃতিতে বলেছে, “পেজার বিস্ফোরণের পিছনে ইজরায়েলের হাত রয়েছে। এর ফল ওদের ভুগতে হবে।”
হেজবোল্লার অবস্থান
প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ হেজবোল্লাকে টার্গেট কেন? ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবোল্লা। আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন হেজবোল্লাকে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু তাদের প্রতি সমর্থন রয়েছে ইরানের। হেজবোল্লা আবার প্যালেস্তাইনের হামাসকে সমর্থন করে। ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধে তারা ইজরায়েলের প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে। সম্প্রতি ইরানের মাটিতে হামাস শীর্ষনেতা ইসমাইল হানিয়ে এবং ইজ়রায়েলি হানায় হেজবোল্লার সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার নামেহ নাসেরের মৃত্যুতে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি আরও তপ্ত হয়েছে। তার পর থেকে ইজ়রায়েল এবং হেজবোল্লার মধ্যে ছোট-বড় সংঘর্ষ লেগেই রয়েছে।
হেজবোল্লার দাবি
ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধের জেরে প্রতিদিনই আগুনের ঝলকানি, বোমা-গুলি-সাইরেনের শব্দে ঘুম ভাঙছে পশ্চিম এশিয়ায়। তবে এই হামলায় সরাসরি ইজরায়েলকে দুষে হেজবোল্লা জানিয়েছে, এই ঘটনা সাম্প্রতিক সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা লঙ্ঘন। পরিকল্পনা মাফিক হামলা চালানো হয়েছে। সামান্য পরিমাণ বিস্ফোরক আগে থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল পেজারগুলিতে। ইজরায়েল তাদের যোগাযোগের মাধ্যমকেই হাতিয়ারে পরিণত করেছে। ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধ চলাকালীন, হেজবোল্লার সঙ্গেও তাদের সংঘাত দেখা গিয়েছে। পরস্পরকে লক্ষ্য করে রকেট, ড্রোন ছুড়েছে তারা।
বিস্ফোরণের ছক
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করা হয়েছে পেজারে ব্যবহৃত লিথিয়ামকে। সাইবার হামলার ছকেই প্রথমে ইলেকট্রনিক সিগন্যাল বিঘ্নিত হয়। তারপরই ব্যাটারি তেঁতেঁ উঠে বিস্ফোরণ ঘটে। এই হামলার পর থেকেই হেজবোল্লা গোষ্ঠীর অন্দরে তদন্ত শুরু হয়েছে। একসঙ্গে এতগুলি পেজারে বিস্ফোরণ ঘটল কী করে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সদস্যদের পেজার ব্যবহার নিয়েও সতর্ক করেছে তারা। ইজরায়েল এবার স্নায়ু যুদ্ধে নেমেছে, মনোবল ভেঙে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য বলে দাবি করেছে হেজবোল্লা। যদিও ইজরায়েল এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
পেজারের পরিচয় রহস্য
যে পেজারগুলিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেগুলি তাইওয়ানের গোল্ড অ্যাপোলো সংস্থার তৈরি। হেজবোল্লার তরফে তাইওয়ানের ওই সংস্থায় ৫০০০ পেজারের বরাত দেওয়া হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। ওই পেজারগুলির মডেল ছিল AP924. যে পেজারগুলিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার পিছনের অংশে গোল্ড অ্যাপোলোর লোগো ছিল। কিন্তু গোল্ড অ্যাপোলোর দাবি, তাদের তৈরি পেজারে বিস্ফোরণ ঘটেনি। বরং BAC নামক এক সংস্থাই সেগুলি তৈরি এবং বিক্রি করে। এই ঘটনায় তাইপেই-তে ইতিমধ্যেই নির্মাণ সংস্থায় পুলিশ এসে পৌঁছেছে।
কাঠগড়ায় মোসাদ
বিস্ফোরণের ঘটনায় ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে হেজবোল্লা। হেজবোল্লার দাবি, ওই পেজারগুলিতে তিন গ্রাম করে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেয়। পেজারের নকশায় বদল ঘটায় তারা। ভিতরে একটি বোর্ড ঢুকিয়ে দেয়, যার মধ্যে বিস্ফোরক পদার্থ রেখে দেওয়া হয়। ওই বোর্ড থেকে সরাসরি মোসাদের কাছে সঙ্কেত চলে যেত। এত সূক্ষ্ম ভাবে বিস্ফোরক ঢোকানো হয়েছিল যে স্ক্যানারেও তা ধরা পড়েনি। পেজারগুলি কয়েক মাস আগেই হেজবোল্লার হাতে এসে পৌঁছেছিল। উল্লেখ্য, এর আগে হামাস জঙ্গিদের নিশ্চিহ্ন করতে বুবি ট্র্যাপড সেলফোন ব্যবহার করেছিল ইজরায়েলি সেনা।