অনুসূয়া দাস, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ গণভবন। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার হয়েছে এই গণভবন। তবে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার হলেও বাসভবন হিসাবে শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ থাকেননি গণভবনে। কীভাবে… কতটা লড়াই করে এই গণভবনকে নিজের কব্জায় আনলেন শেখ হাসিনা?
ঢাকার শেরে বাংলা নগরে বিশালাকার জায়গা জুড়ে এক স্থাপত্য। কম বিতর্কে জড়ায়নি এই গণভবন। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়কাজে ব্যবহার হয়েছে গণভবন। বাংলাদশের প্রাক্তন সকল নেতা থেকে মন্ত্রী গণভবনকে রাষ্ট্রের কাজেই ব্যবহার করেছে। সেই গণভবনেই প্রথম বসবাস করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। তখনই তাঁর চোখ পড়ে গণভবনের দিকে। সেইসময় তিনি গণভবন বরাদ্দ নিয়ে সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়লেও তিনি গণভবন কখনই ছাড়তে চাননি। তবে তিনি কোনও পদে নেই, তাই তাঁকে ছাড়তে হবে সেই ভবন। এই নিয়ে শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক উত্তাপ। সেই আবহে ২০০১ সালে গণভবন ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।
২০০১ সালের ২০ জুন তাঁর হাতেই সংসদে এক বিশেষ আইন পাশ হয়। সেই আইনে বলা হয় আজীবন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এসএসএফ দ্বারা নিরাপত্তা পাবে এবং পাবেন পৃথক এক আবাসন। আইন পাশের এক সপ্তাহ পরই তাঁর ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ছিল।
২০০১ সালের ২ জুলাই আওয়ামি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনাকে গণভবন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই আইনের ক্ষমতাবলে শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানাকে ধানমুণ্ডির ৬ নং ওয়ার্ডের এক বিঘার সরকারি বাড়ির বরাদ্দ দেওয়া হয়।
হাসিনাকে গণভবন বরাদ্দ দেওয়ার পিছনে উঠে আসে একাধিক কারণ….
কী কী সেই কারণ?
১. প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি যে দেওয়া হয়েছে. তাতে নিরাপত্তা কর্মীরা মনে করেন, গণভবন তাঁর থাকার জন্য সঠিক জায়গা।
২. শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে এই ভবনের নাম ছিল গণভবন। পরে তাঁকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন করা হয়।
৩. ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তার নাম ফের গণভবন করা হয়।
৪. মন্ত্রিসভায় ঠিক হয় শেখ হাসিনা গণভবনে থাকবেন। এবং তাঁর সঙ্গে থাকবেন তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা।
৫. ১৯৮১ সালের ১২ জুন মন্ত্রিসভায় ঠিক হয়, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া যে সব সরকারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন. তা পাবেন।
শেখ হাসিনার গণভবনের বরাদ্দ নিয়েও কম বিতর্ক তৈরি হয়নি। সবথেকে বেশি কটাক্ষের সুর ধেয়ে আসে বিএনপির তরফে। আপত্তি তুলে সাংবাদিক বৈঠক করেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। তখন রাজনৈতিক তর্ক বিতর্কে সাময়িক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনার গণভবন বরাদ্দ বাতিলের দাবি জানানো হয়। অন্যদিকে পাল্টা দাবি তোলা হয় আওয়ামী লিগের তরফে। খালেদা জিয়া যেন তাঁর সেনা নিবাসের বাড়ি ছেড়ে দেন।
১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া ও তাঁর দুই ছেলেকে ১০ লক্ষ টাকা নগদ ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে ঢাকা সেনানিবাসের বাড়িটি রেজিস্টিকৃত দলিলের মাধ্যমে কিছু শর্তে ইজারা দেওয়া হয়। বাড়িটিতে জমির পরিমান ছিল ২ দশমিক বাহাত্তর একর। খালেদা জিয়ার সেই বাড়ি বাতিল করা হবে না কেন, সেইমর্মে দুটি নোটিস জারি করা হয়। যেখানে বলা হয়।নোটিসে উল্লেখ খালেদা জিয়া বাড়ি ও এজারার শর্ত ভঙ্গ করেছেন।তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গণভবন দেওযার বিষয়টিকে বাতিল করার সিদ্ধান্তকে আইনগত ভাবে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নেন বিএনপি।২০০১ সালের ২রা জুন সংসদে যে আইন পাশ হয়. তা অসংবিধানিক বলে যুক্তি দিয়েছিল বিএনপি। বলা হয় আইনটি দেশের নাগরিকের বিপরীতে গিয়ে কেবলমাত্র দুটি মানুষের জন্য প্রযোজ্য হয়। এর মধ্যে হয়ে যায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন । ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে নির্বাচনে জয় লাভ করে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ডিসেম্বর মাসে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা আইন ২০০১ বাতিল করা হয়।
ফের একবার উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মাটি। উত্তপ্ত বাংলাদেশের মধ্যে গণভবন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। ২০০১ সালের ১৬ অগাস্ট গণভবন ছেড়ে দেন তিনি। বাড়ি ছাড়ার সময় সাংবাদিক বৈঠকে বলেছিলেন, বাড়ি নিয়ে এত কথা শুনতে ভালো লাগে না।বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুরের সময় গণভবন নির্মাণ করা হয়। তবে শেখ মুজিবুর সেখানে বসবার করতেন না। তিনি পরিবার নিয়ে বসবার করতেন ধানমুণ্ডির ৩২ নং সড়কের বাড়িতে। যেটি পরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর করা হয়। ২০০১ সালে শেখ মুজিবুর তখন বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন গণভবন অফিসের কাজে ব্যবহার করতেন। মূলত বিকেল ও সন্ধ্যাকালীন অফিস হিসাবে এটি ব্যবহার করা হত। শেখ মুজিবুর হত্যাকাণ্ডের পর গণভবন অনেকটাই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকত বলে জানা যায়। ১৯৮৫ সালে গণভবন সংস্কার করে সেটিকে রাষ্টীয় অতিথি ভবন করে ব্যবহার করা হত। বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারি প্রধানদের জন্য এই অতিথি ভবন ব্যবহার করা হতো। এক সময়ে ঢাকা সফরে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বসবাস করেছিলেন। এরপর ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়লাভ প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। আবার তিনি বসবাস শুরু করেন এই ভবনে। তখন নাম ফের দেওয়া হয় গণভবন। ২০০১ সালে শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়ে যাওয়ার পর কয়েক বছর সেটি আর ব্যবহার করা হয়নি। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লিগের ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা প্রথমে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় উঠেছিলেন । তারপর গণভবন সংস্কার শেষে ১৪ মাস পরে ২০১০ সালের মার্চ মাসে শেখ হাসিনা গণভবনে বসবাস করা শুরু করেন। তাঁর আমলে বেশিভাগ কাজ এই ভবন থেকেই করা হয়। গণভবনকে এখন জুলাই স্মৃতি যাদুঘর করার কথা ভাবছেন মহম্মদ ইউনুস।