নারায়ণ দে, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতে পালিয়ে আসেন গত ৫ অগাস্ট। তারপর কেটে গিয়েছে একমাস। এই এক মাসে নতুন সরকার থেকে প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। পরিবর্তন আনা হয়েছে অর্থ ও শিক্ষা খাতে। শুধু কী তাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি হোক বা জামায়াতে ইসলামের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়া থেকে দলে দলে জঙ্গিদের মুক্তি, এসবই ঘটেছে গত একমাসে বাংলাদেশে।
হাসিনার পদত্যাগ ও দেশে অস্থির পরিস্থিতি
৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর একদিকে তিনি যখন আকাশপথে ভারতে আসছিলেন। তখন বাংলাদেশের গণভবনে আন্দোলনকারীদের একাংশ ঢুকে পড়ে রীতিমতো লুঠপাট চালায়। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওইদিনই দেশের সেনা বাহিনীর প্রধান বিশৃঙ্খলা থামানোর আবেদন করেন। একইসঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি অন্তবর্তী সরকার গঠনের আশ্বাস দেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠন
আন্দোলনকারী ছাত্ররা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে বেছে নেয় নোবেলজয়ী ড. মহম্মদ ইউনুসকে। গণঅভ্যুত্থানের দিন তিনি ছিলেন প্যারিসে। দেশে ফিরেই ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন ড. ইউনুস। একইসঙ্গে ১৩ জন উপদেষ্টা শপথগ্রহণ করেন। শপথের ১৬ ঘণ্টার মধ্যেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়।
খালেদা জিয়া ও ড. ইউনুসের সাজা বাতিল
আওয়ামী লীগ শাসনকালে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মহম্মদ ইউনুসকে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার আগের দিন সাজা বাতিল করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অন্যদিকে, শেখ হাসিনার সরকারের আমলে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার। কিন্তু সরকার পতনের একদিন পরেই রাষ্ট্রপতি তাঁর সাজা মুকুব করে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন।
শেখ হাসিনা-সহ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পদ্যত্যাগের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়। একাধিক মামলা দায়ের করা হয় সজীব ওয়াজেদ, সায়মা ওয়াজেদ, শেখ রেহানা-সহ আওয়ামী লীগ সভাপতির পরিবার ও তাঁর আত্মীয়দের বিরুদ্ধেও। আনিসুল হক, টিপু মুনশি, দীপু মণি, সালমান এফ রহমান, জুনাইদ আহমদ পলক-সহ অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালতে পেশ করার সময় তাদের অনেকের ওপর হামলাও হয়েছে। এছাড়া বাতিল করা হয়েছে শেখ হাসিনা-সহ আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট।
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সক্রিয় জামায়াত
ক্ষমতা হারানোর চারদিন আগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ নম্বর ধারায় ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ ও তাদের ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’কে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের তৃতীয় সপ্তাহেই তুলে নেওয়া হয় ওই নিষেধাজ্ঞা। ফলে দলটির নেতাকর্মীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। সারা দেশের পাড়া-মহল্লায় তাদেরকে জনসংযোগ করতে দেখা যাচ্ছে।
খুনি ও জঙ্গিদের মুক্তি
শেখ হাসিনার পদ্যত্যাগের দিন, ৫ অগাস্টই জেল ভেঙে কয়েকশো দাগি আসামি পালিয়েছে। তারপর আরও দুটি জেল ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। এরইমধ্যে সে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের চিন্তা বাড়িয়েছে একের পর এক প্রথম সারির খুনি-সন্ত্রাসির জামিনে মুক্তি। যাদের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের খুনের অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশের কর্মবিরতি ও তারপর থানায় ফেরা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশের অন্তত ৪৫০টি থানায় হামলা চলে। ভাঙচুর করে থানা জ্বালিয়ে দেওয়া, অস্ত্র ও মালামাল লুট, এমনকী পুলিশ হত্যার ঘটনাও তখন ঘটে। পুলিশ কর্মী ও আধিকারিক মিলিয়ে কমপক্ষে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এমতাবস্থায় নিরাপত্তার অভাবে কর্মবিরতিতে চলে যায় বাংলাদেশ পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বেশ কয়েক দফা বৈঠকের পর পুলিশের দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। তারপর একে একে পুলিশকর্তা ও কর্মীরা কাজে ফেরেন। দেশবাসীর প্রতি পুলিশের ওপর বিশ্বাস ফেরাতে পোশাক, লোগো পরিবর্তন-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের তোড়জোড় চলছে।
প্রশাসনিক মহলে ব্যাপক রদবদল
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর। স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নতুন করে বদলি, পদায়ন ও নিয়োগ করা হয়েছে কয়েকশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে। বাদ পড়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের দায়িত্বে থাকা তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করা মাসুদ বিন মোমেন। ছয়ই অগাস্ট চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের চুক্তি বাতিল করে নতুন পুলিশ মহাপরিদর্শক বা আইজিপি করা হয় অতিরিক্ত আইজিপি’র দায়িত্বে থাকা মো. ময়নুল ইসলামকে। বেশ কয়েকজন পুলিশকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে।
বিচার বিভাগে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন
কোটা সংস্কার নিয়ে রায় দেওয়ার পর ১০ই অগাস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরাও তার সঙ্গে পদত্যাগ করেন। নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন আপিল বিভাগের বিচারক সৈয়দ রেফাত আহমেদ। একইভাবে, আপিল বিভাগে নতুন আরও চার বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এদিকে, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের স্থলাভিষিক্ত হন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান। সারা দেশে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ২২৭ জন আইনজীবীকে নতুন নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের ৬৬ আইনজীবীকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ১৬১ আইনজীবীকে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
পদত্যাগের হিড়িক
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে গত চার সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য-সহ একাধিক শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে গত নয়ই অগাস্ট পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তার আগের দুদিনে ডেপুটি গভর্নর-সহ অন্তত চারজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সাদা কাগজে লিখিত দিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করানো হয়। একইভাবে, গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকা ওয়াসা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থাকা কর্তাব্যক্তিরা পদত্যাগ করেছেন।
আর্থিক খাত সংস্কারে উদ্যোগ
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংকিং খাতে ‘নজিরবিহীন লুটপাট’ হয়েছে বলে অভিযোগ। ব্যাংকিং খাতের টেকসই সংস্কারে ইতিমধ্যেই আলাদা ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ‘লুটপাটে’র শিকার হওয়া বেশ কিছু ব্যাংকের আগের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত করেছে অন্তর্বতী সরকার। তিন মাসের মধ্যে তারা রিপোর্ট জমা করবেন।
শিক্ষা খাতে পরিবর্তন
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত ১৮ই জুলাই মাঝপথে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলি। সরকার পতনের পর সিদ্ধান্ত হয় বাকি পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে ১১ই সেপ্টেম্বরের পর। পরীক্ষার্থীদের একাংশ বিক্ষোভ দেখালে ‘অনিবার্য কারণ’ দেখিয়ে গত ২০শে অগাস্ট এইচএসসি’র বাকি বিষয়ের পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়। ফলাফল কীভাবে হিসাব করা হবে, সে বিষয়ে স্পষ্টকরে কিছু বলা হয়নি। অন্যদিকে, চলতি বছর নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন তুলে দিয়ে নতুন যে শিক্ষাক্রম আওয়ামী লীগ সরকার চালু করেছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সেটিতে সংস্কার এনে আবারও বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিক্ষোভ-ঘেরাও, অচলাবস্থা বজায়
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক সরকারি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান ও ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের বিক্ষোভ। ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিল করে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে গত ২৫শে অগাস্ট সারাদিন সচিবালয় অবরোধ করে রেখেছিলেন এই আধা-সামরিক বাহিনীর প্রায় দশ হাজার সদস্য। আলোচনার মাধ্যমে বিকেলে সরকারের পক্ষ থেকে ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিল ঘোষণা করা হলেও আন্দোলন থামাননি তারা। পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের জড়িয়ে পড়েন আনসার সদস্যরা, যাতে উভয়পক্ষের অর্ধ-শতাধিক মানুষ আহত হয়। অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার সাড়ে তিনশ’র বেশি আনসার সদস্যকে গ্রেফতার দেখিয়ে পরবর্তীতে কারাগারে পাঠানো হয়।
১৫ই অগাস্টের ছুটি বাতিল
১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান-সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রাণে মেরে ফেলা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গত দেড় দশক ধরে শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুদিন ১৫ই অগাস্টে সারা দেশে শোকদিবস পালন হত। ওইদিন সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু শপথ নেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ১৫ই অগাস্টের সরকারি ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।