পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ কোটাবিরোধী আন্দোলনের জেরে পদ ও দেশত্যাগ করে আগেই চলে গিয়েছেন শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)। কিন্তু বাংলাদেশকে ফেলে রেখে গেলেন লোকসান ও অন্ধকারের মুখে। ৭ বছর আগের হাসিনা-আদানি গুপ্ত বিদ্যুৎ চুক্তির ফলে চরম বিপাকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশ সরকারের কাছে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার পাওনা রয়েছে। এমনটাই জানিয়েছে ভারতীয় সংস্থা আদানি শিল্প গোষ্ঠী।
হাসিনা-আদানি গুপ্ত চুক্তি
২০১৫ সাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথমবার বাংলাদেশ সফরে যান। মুজিবকন্যার সঙ্গে তখনই আলোচনা হয়েছিল বিদ্যুত্ সরবরাহ সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়ে। মোদী-হাসিনার কথোপকথনে উঠে আসে একটিই নাম, গৌতম আদানি।ব্যাস। এরপর ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ার লিমিটেডের মালিক তথা শিল্পপতি গৌতম আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে একটি বিদ্যুত্ চুক্তি সাক্ষরিত হয়। নাম দেওয়া হয় গোড্ডা বিদ্যুত্ প্রকল্প। সে সময় চুক্তিপত্রের লেখা খানিকটা জনতার সামনে প্রকাশ করা হলেও বেশিরভাগটাই রেখে দেওয়া হয়েছিল গুপ্ত।
কী কী ছিল সেই গুপ্ত চুক্তিতে ?
২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন পর্ষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চুক্তিটি স্বাক্ষর করে আদানি গোষ্ঠী। স্থির হয়, ২৫ বছরে মোট ১,৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনাবেচা করা হবে। আদানি গোষ্ঠীর ঝাড়খণ্ডের কেন্দ্রের উৎপাদিত ১০০ শতাংশ বিদ্যুৎই কিনবে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে সরাসরি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আদানি গোষ্ঠী।সেই অনুযায়ী ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলায় ১৬০০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিদ্যুত্ রফতানির জন্যই এই বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি গড়া হয়। ওই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আদানি গোষ্ঠী আবার ইন্দোনেশিয়া থেকে উন্নতমানের কয়লা আমদানি করে।
গোড্ডা টু বাংলাদেশ
২০১৯ সালের মার্চ মাস এই কেন্দ্রটিকে বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকার (এসইজেড) আওতাভুক্ত বলে ঘোষণা করে মোদী সরকার। চুক্তি ২০১৭-য় হলেও গোড্ডা কেন্দ্রটিতে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল-জুন মাসে। বাংলাদেশের মোট চাহিদার ৭ থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আদানি গোষ্ঠীর এই কেন্দ্র।এরপর ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে এই কেন্দ্র থেকে ৭,৫০৮ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ রফতানি করা হয়। যা ভারত থেকে বাংলাদেশে রফতানি করা মোট বিদ্যুতের প্রায় ৬৩ শতাংশ। ওই অর্থবর্ষে বাংলাদেশকে মোট ১১,৯৩৪ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ রফতানি করেছিল ভারত।টাকার অঙ্ক হিসাব করলে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ রফতানি করে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থমূল্যের ব্যবসা করেছে ভারত। যা ভারত থেকে বাংলাদেশে মোট রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ।
ইউনুসকে গৌতমের চিঠি
এদিকে হাসিনা দেশ ছাড়তেই উত্তপ্ত বাংলাদেশে লোডশেডিং শঙ্কা জাগায় আদানি গোষ্ঠী। সম্প্রতি গৌতম আদামির সংস্থা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী ইউনুস সরকারকে পাঠানো চিঠিতে জানায়, অবিলম্বে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বকেয়া মেটাতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। তাদের বক্তব্য, এত টাকা বকেয়া রেখে বিদ্যুৎ নেওয়া মোটেই স্বাস্থ্যকর ব্যবসায়িক দৃষ্টান্ত নয়। বাংলাদেশ সরকার বকেয়া বিল না মেটানোয় তারা তাদের পাওনাদারদের প্রাপ্য মেটাতে পারছে না। আদানি গোষ্ঠী অবশ্য জানিয়েছে বকেয়া চাওয়ার অর্থ এই নয় যে তারা বিদ্যুৎ দেওয়া বন্ধ করে দেবে।
বিদ্যুৎ চুক্তির ঝটকা
এরফলে ২৫ বছরের জন্য করা সেই চুক্তি নিয়েই বড়সড় ঝটকা খেল বাংলাদেশ। গুপ্ত বিদ্যুত্ চুক্তিরই এখন মাসুল গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী ইউনুস সরকারকে।ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর বিদ্যুত্ বিক্রয় চুক্তি খতিয়ে দেখতে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। ওই কমিটির তরফেই সেই চুক্তির প্রত্যেকটি শর্ত পর্যালোচনা করা দেখা হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাবদ আদানি গোষ্ঠীকে এত দিন ঢাকার তরফে যে টাকা দেওয়া হয়েছে, তা আদৌ যুক্তিযুক্ত কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনা-বেচা সংক্রান্ত চুক্তির ধরন ঠিক কেমন, তাতে কী কী শর্তাবলী রয়েছে ইত্যাদি পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে।
আদানি বনাম বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উপদেষ্টা
তবে আদানিদের চিঠি যে বাংলাদেশ সরকারকে বিপাকে ফেলেছে তা দেশের বিদ্যুৎ উপদেষ্টার কথায় স্পষ্ট। উপদেষ্টা ফওজুল কবির খান বলেছেন, আমাদের টাকা নেই। বিশ্বব্যাঙ্ক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের কাছ থেকে ধার নিয়ে আদানিদের বিল মেটানোর চেষ্টা হচ্ছে।শুধু তাইই নয়। ভারত বিরোধী বাংলাদেশের এক গোষ্ঠীর দাবি, আদানিদের কাছ থেকে অনেক চড়া দরে বিদ্যুৎ কিনছে বাংলাদেশ। তাছাড়া, চুক্তিতে একটি শর্ত আছে যে বাংলাদেশ সরকার কোনও দিন পুরো বিদ্যুৎ না নিলেও ১৬০০ মেগাওয়াটের দাম আদানিদের দিতে হবে।তবে কি এবার হাসিনা বিনা অন্ধকার হয়ে যাবে বাংলাদেশ ? নাকি আলোর পথ দেখাবে ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার? উত্তর বলবে সময়ই।