নারায়ণ দে,নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ১৯১৪ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কিন্তু আপনি কী জানেন আজ থেকে ২৪ বছর আগে ১৯৯৫-এ বিশ্বব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট দাবি করেছিলেন, এতদিন পর্যন্ত যে সব যুদ্ধ হয়েছে তা বুলেট, বোমা, ও অস্ত্র দিয়ে। কিন্তু ভবিষ্যতে জলকে হাতিয়ার করেও যুদ্ধ হতে পারে। সিন্ধু জলচুক্তির পুনর্মূল্যায়ন চেয়ে পাকিস্তানকে পাঠানো ভারতের চিঠি মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই সময় হয়তো আর বেশি দূরে নেই। তাহলে কী আরও একবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী? প্রশ্ন উঠছে কারণ, ভারত চিঠিতে পাকিস্তানকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, ইসলামাবাদ সস্ত্রাস দমনে পদক্ষেপ না করলে সিন্ধু নদের জল আটকে দেবে নয়া দিল্লি।
১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খান বিশ্বব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় সিন্ধু নদীর জল বণ্টন নিয়ে এই চুক্তি সাক্ষর করেছিলেন। পাকিস্তানেরকরাচি শহরে গিয়ে এই চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন পণ্ডিত নেহরু। চুক্তি অনুযায়ী, পূর্ব দিকের তিনটি নদী, রবি, বেয়াস ও সাতলাজ অর্থাৎ বিপাশা, ইরাবতী ও শতদ্রুর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের। অন্য দিকে পশ্চিম দিকের ইন্ডাস, ঝিলাম ও চেনাব অর্থাৎ সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল ব্যবহার করতে পারবে পাকিস্তান। এই ছটি নদীতে ১৬ দশমিক ৮ কোটি একর ফিট জল রয়েছে। জলের নিরিখে সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদী মিলিয়ে ৩০ শতাংশ পায় ভারত ও ৭০ শতাংশ পায় পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানের ভাগে থাকা নদীগুলির জল ব্যবহারে ভারতের ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। জলাধার বা বাঁধ তৈরি ছাড়া বাকি সবক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে।
যখন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তখন নয়া দিল্লি জানত যে এই চুক্তির ফলে পাকিস্তান বেশি লাভবান হবে। তা সত্ত্বেও চুক্তি স্বাক্ষর করেন জওহরলাল নেহরু এই ভেবে যে এই চুক্তির পর পাকিস্তান ভারতকে সমীহ করবে। এমনকী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপেও ইসলামাবাদ মদত দেবে না। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে একদম উল্টো। ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত পাক যুদ্ধের নেপথ্যে ছিল সিন্ধু নদীর জলের দখল। সেই কারণেই কাশ্মীর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বাধীন সরকার। সিন্ধু জলচুক্তির পরেও যুদ্ধ থেকে বিরত থাকেনি পাকিস্তান। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালে যুদ্ধ হয় ভারত-পাকিস্তানের। কমেনি ধারাবাহিক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপও। কিন্তু তারপরও অটুট রয়েছে সিন্ধু জলচুক্তি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
চলতি বছরের ৩০ অগস্ট সিন্ধু জলচুক্তি নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে পাকিস্তানকে চিঠি পাঠায় ভারত। তাতে এই চুক্তিতে মূলগত পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ ৬৪ বছর আগে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া সিন্ধু জলচুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। এই চুক্তিতে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। বিশ্ব ব্যাঙ্কের এই ভূমিকায় প্রথম থেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে নয়াদিল্লি। সালিশি আদালত ভেঙে দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে ভারত। যা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি বিশ্ব ব্যাঙ্ক।
১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের পাঠানো নোটিস নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে ইসলামাবাদ। পাক বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মুমতাজ জাহরা বালোচ জানিয়েছেন, ‘সিন্ধু জলচুক্তিকে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা বলে মনে করে। আশা করি আগামী দিনেও ভারত এই চুক্তির শর্তগুলি মেনে চলবে।’ কিন্তু একইসঙ্গে সীমান্তে সন্ত্রাসবাদী হামলা আর সিন্ধু জলচুক্তি অটুট থাকতে পারে না বলে মত নয়া দিল্লির। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতেই সিন্ধু চুক্তির পুনর্মূল্যায়ণের জন্য প্রথম বার পাকিস্তানকে নোটিস পাঠিয়েছিল নয়াদিল্লি। ইসলামাবাদের তরফে সে বার কোনও সাড়া মেলেনি। এ বার দ্বিতীয় নোটিসে পাকিস্তান সাড়া দেওয়ায় বোঝা যাচ্ছে নয়া দিল্লির প্রস্তাবকে আর ফুৎকারে ওড়াতে চাইছে না ইসলামাবাদ। নয়া দিল্লি এই চুক্তি সত্যিই ভেঙে দিলে জলের জন্য ফের পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের সেনা লড়াইয়ের ময়দানে মুখোমুখি হতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহল।