নারায়ণ দে, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ফের রক্তাক্ত মণিপুর। নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে উত্তর-পূর্বের ছোট রাজ্যটি। পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘর্ষে ১১ জনের প্রাণ গিয়েছে। কমবেশি আহত প্রায় ৫০ জন। দিকে দিকে জ্বলছে আগুন। এমন পরিস্থিতিতে পাঁচদিনের জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। ভিপিএন ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এছাড়াও তিন জেলা পূর্ব ইম্ফল, পশ্চিম ইম্ফল ও থৌবালে জারি কারফিউ। এই প্রথম নয়, এর আগেও দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছিল মণিপুরে। গতবছরের ৩ মে থেকে শুরু হওয়া হিংসায় সরকারি হিসাবে এখনও পর্যন্ত ২৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। ৩২ জনের মতো নিখোঁজ। প্রায় ৫ হাজার ঘর-বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই। ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ ঘরছাড়া। নিজের দেশেই উদ্বাস্তুর মতো বছর কাটছে তাঁদের। হামলা-ভাঙচুরের মতো ঘটনায় ৪০০টির মতো ধর্মীয় স্থান পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। মেরি কম থেকে মণিপুরের বিশিষ্টজনেরা বার বার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের দাবি করেছেন। এই ধরনের হিংসার ঘটনা যদি গুজরাতে দীর্ঘদিন ধরে চলত, তাহলে কী করতেন? এই মর্মে অমিত শাহকে চিঠি লিখেছেন মণিপুরের কংগ্রেস বিধায়ক এ বিমল আকোইজাম। কিন্তু কেন এই সহিংসতা? কাদের মধ্যেই বা এই সংঘর্ষ? সংঘর্ষের কারণ কী? প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার অর্থাৎ বিজেপির ডাবল ইঞ্জিন সরকারের ভূমিকা কী? কেন মণিপুর বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলির হেডলাইন হয়ে উঠছে? প্রতিটি ঘটনা নিয়েই আলোচনা করব ।
ভৌগলিক অবস্থান, ইতিহাস, অর্থনীতি আর জনসংখ্যা বিন্যাস। এই চারটি বিষয় না জানলে মণিপুরের আজকের পরিস্থিতি বোঝা খুব মুশকিল।
মণিপুরের ভৌগলিক অবস্থান
মণিপুর ভারতের উত্তর-পূর্বের একেবারে প্রান্তিক একটি রাজ্য। তারওপর মায়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘ সীমানা ভাগ। রাজ্যটির মাঝের অংশ উপত্যকা এবং চারদিকে পাহাড়। ইম্ফল ভ্যালি রাজ্যটির মাত্র ১০ শতাংশ জায়গা জুড়ে। বাকি ৯০ শতাংশই পাহাড়ি এলাকা। অথচ উপত্যকায় প্রায় ৫৭ শতাংশ মানুষের বসবাস। আর পাহাড়ি এলাকায় মাত্র ৪৩ শতাংশ। যদিও যাবতীয় সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা মেলে ভ্যালিতেই। এমনকী, চাষাবাদও হয় ভ্যালিতেই। স্বাভাবিকভাবে পাহাড়ের চেয়ে ভ্যালির অর্থনীতি বেশি শক্তিশালী। এহেন ভৌগলিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সামাজিক বৈষম্যও স্বাভাবিক। বৈষম্য মণিপুরের মেইতেই এবং কুকি ও নাগার মধ্যে। মেইতেই-এর জনসংখ্যার হার প্রায় ৬০ শতাংশ, যার বেশিরভাগটাই উপত্যকায় বসবাসকারী। কুকি ও নাগা জনজাতির হার মাত্র ৪০ শতাংশ। যাদের বাস পাহাড়ি এলাকায়। অর্থাৎ মেইতেই সম্প্রদায়ের সুযোগ-সুবিধা বেশি, কুকি ও নাগার জনজাতির মানুষ সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক ভাবেও মেইতেই জাতির প্রভাব বেশি। মণিপুর বিধানসভার মোট ৬০ আসনের মধ্যে ৪০টি আসনই মেইতেই জাতি অধ্যুষিত।
মণিপুরের ইতিহাস
ইতিহাস বলে, মেইতেই জাতির মানুষজন একসময় উত্তর মায়ানমার এলাকা থেকে এসে ইম্ফল ভ্যালিতে ঘাঁটি গড়ে তোলে। ১৭৩০-এর সময় ইম্ফল ভ্যালির হিন্দু রাজা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে। অন্যদিকে পাহাড়ি এলাকায় আদিবাসী কুকি, মিজো, নাগা জনজাতির বসবাস। কিন্তু সামাজিকভাবে উন্নত হওয়ার কারণে বরাবর মেইতেই জাতি ইম্ফল ভ্যালির পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকার আদিবাসীদের ওপর নিজেদের প্রভাব খাটাতে পারে। এদিকে কখনও আজকের মায়ানমার অর্থাৎ তৎকালীন বার্মা আক্রমণ চালায় মণিপুরের ওপর, আবার কখনও ব্রিটিশরা শাসন করে। ১৯৪৯-এ মণিপুরের রাজা ভারতের সঙ্গে রাজ্যটিকে অন্তর্ভূক্তি করেন। তারপরও মেইতেই ও কুকির মধ্যে সম্পর্কে তেমন উন্নতি ঘটে না।
জনসংখ্যা বিন্যাস
উত্তর পাহাড়ি এলাকায় নাগা জনজাতি ও দক্ষিণ পাহাড়ি এলাকায় কুকি জনজাতির বসবাস। মূলত শিকার করেই তাদের জনজীবন অতিবাহিত হয়। এই দুই জনজাতির মধ্যে বিভেদ থাকলেও মেইতেই সংম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সবসময় একই অবস্থানে থেকেছে। আর এখানেই আশঙ্কার কালো মেঘ ঘিরে ফেলতে শুরু করে মেইতেইদের। তাদের অভিযোগ, ধীরে ধীরে মণিপুরে তারাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে। সংকুচিত হয়ে পড়ছে ভ্যালিতে মেইতেইদের থাকার জায়গা। এর কারণ হিসাবে দাবি করা হয়, কুকি-নাগাদের মতো তাদের তফশিলি উপজাতির তকমা নেই। যে কারণে পাহাড়ি এলাকায় তারা জমিও কিনতে পারে না। এদিকে মায়ানমার থেকে কুকিদের অনুপ্রবেশ ক্রমেই বাড়ছে। ভ্যালির যে ১০ শতাংশ জায়গা, সেটাও তাদের দখল থেকে আস্তে আস্তে অন্যদের হাতে চলে যাচ্ছে। যে কারণে কিছু মেইতেই সম্প্রদায় তফশিলি উপজাতির তকমার দাবি করে। ১৯৮২ ও ২০০১-এ এই দাবি উঠলেও প্রতিবার প্রত্যাখান করে দেওয়া হয়। ২০২২-এ মণিপুরে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ওই দাবি ফের উঠতে শুরু করে। মেইতেই সম্প্রদায়ের ক্ষোভ প্রশমিত করতে ৭ নভেম্বর ২০২২-এ, মণিপুর সরকার পুরনো নির্দেশ সরিয়ে রেখে চুড়াচাঁদপুরের প্রায় ৩৮টি গ্রাম অধিগ্রহণ করে। আফিম চাষের অভিযোগে আদিবাসীদের উচ্ছেদ শুরু হয়। কিন্তু তাতেও মেইতেই সম্প্রদায়ের দাবি স্থিমিত হয়নি।
সংঘর্ষের সূত্রপাত
২০২৩-এর ২০ এপ্রিল মেইতেই সম্প্রদায়ের কিছু সংগঠন তফশিলি উপজাতির তকমা চেয়ে মণিপুর হাইকোর্টে মামলা করে। হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয় বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করতে। স্বাভাবিকভাবেই কুকি জনজাতির মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়, মেইতেই এসটি তকমা পেলে পাহাড়ি এলাকাও দখল করে ফেলবে। আদিবাসী নেতাদের ফোরাম আইটিএলএফ রাজ্য সরকারের পদক্ষেপের প্রতিবাদে ২৮ এপ্রিল মণিপুর বনধের ডাক দেয়। ওই দিনই চুড়াচাঁদপুরে একটি ওপেন এয়ার জিম সেন্টারের উদ্বোধনের কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রী এন. বীরেন সিংয়ের। কিন্তু আগের দিন একদল জনতা ওই নবনির্মিত জিমে আগুন লাগিয়ে ভাঙচুর করে। এরপর ২৮ এপ্রিল ১৪৪ ধারা জারি করার পাশাপাশি পাঁচ দিনের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয় এবং জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেলও ব্যবহার করা হয়।
৩ মে, ২০২৩। জনজাতি সংগঠন অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন মণিপুর বা এটিএসইউএম মণিপুর হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে পথে নামে। শুরু হয় আদিবাসী সংহতি মার্চ। বিষ্ণুপুর-চুড়াচাঁদপুর জেলা সীমান্তে মেইতেই সম্প্রদায়ের পাল্টা বিক্ষোভে সামিল হয়। হঠাৎ করেই শুরু হয় ইটবৃষ্টি-অগ্নিসংযোগ। দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ৩ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় প্রায় ৮০ জন। ইম্ফল ভ্যালি থেকে প্রায় ৫০০টি পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। পাল্টা চুড়াচাঁদপুরে বসবাসকারী প্রায় ১০০০টি মেইতেই পরিবার বিষ্ণুপুরে এসে আশ্রয় নেয়। রাতেই অসম রাইফেলস ও ভারতীয় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। কারফিউ বর্ধিত করা হয়, সঙ্গে ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ।
৪ মে, ২০২৩। রাত পেরিয়ে নতুন সকাল হলেও সংঘর্ষ থামে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায়। ওইদিন প্রায় নয় হাজার জনেরও বেশি মানুষকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা হয়।
৫ মে, ২০২৩। সংঘর্ষ জারি থাকে। আরও ২০ হাজার জনকে সামরিক তত্ত্বাবধানে ক্যাম্পে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
৬ মে, ২০২৩। সংঘর্ষ চলতে থাকে। আরও ২৩ হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে স্থানান্তর করা হয়। ওইদিন নতুন করে ৫ কোম্পানি র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স, ১০ হাজার সেনা, আধাসামরিক এবং কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়।মণিপুর সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ৯ মে পর্যন্ত মৃত্যু হয় ৬০ জনের।
১০ মে, ২০২৩। শিথিল করা হয় কারফিউ। যদিও ওইদিনই কিছু উগ্রবাদী পূর্ব ইম্ফলে ভারতীয় সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
১২ মে, ২০২৩। সন্দেহভাজন কুকি জনজাতির উগ্রবাদীরা বিষ্ণুপুরে পুলিশকর্মীদের ওপর হামলা করে। একজন পুলিশ অফিসারের মৃত্যু হয়। একটি পৃথক ঘটনায়, চুড়াচাঁদপুর জেলার তোরবুং-এ একজন সৈন্যকে ছুরিকাঘাত করা হয় এবং মেইতেই সম্প্রদায়ের তিন সদস্যকে অপহরণ করা হয়।
১৩ মে, ২০২৩। মণিপুর সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা কুলদীপ সিং জানান, ওইদিন পর্যন্ত ৭০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ ঘরছাড়া।
১৪ মে, ২০২৩। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের নেতৃত্বে রাজ্যের মন্ত্রীদের একটি প্রতিনিধি দল পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করতে নয়াদিল্লি যান। অন্যদিকে ওইদিনই সংঘর্যে আরও ১১ জনের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে ৯ জনই ছিল মেইতেই সম্প্রদায়ের। ওইদিন ২১ বছর বয়সী এক কুকি যুবককে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় ইম্ফলের একটি রাস্তায় তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
১৬ মে, ২০২৩। ইন্টারনেট বন্ধ ও কারফিউয়ের শেষ দিন। ওইদিনও সংঘর্ষ থেমে থাকেনি। এদিকে স্কুল-কলেজ, দোকানপাট বন্ধ। দেখা যায় খাদ্যের অভাব। নতুন করে হাজার হাজার মানুষ ত্রাণ শিবিরে যোগ দেয়। রাজ্যের সাত বিজেপি-সহ ১০ জন বিধায়ক দাবি তোলেন, ‘মণিপুরের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে কুকি অধ্যুষিত এলাকার জন্য পৃথক সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা হোক।’ তাঁদের দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং।
১৭ মে, ২০২৩। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আরও পাঁচদিন ইন্টারনেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২৯ মে, ২০২৩। সংঘর্ষের ঘটনায় একজন পুলিশ-সহ কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়। অন্যদিকে কুকি, মিজো এবং জোমি উপজাতির শত শত মহিলা মণিপুরের ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের দাবিতে নয়াদিল্লির যন্তর মন্তরে বিক্ষোভ শুরু করে। মহিলারা জাতীয় পতাকা হাতে উই আর ইন্ডিয়ান বলে স্লোগান তোলে।
৩০ মে ২০২৩-এ, রাজ্যের এগারো জন আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পুরস্কারজয়ী ক্রীড়াবিদ দাবি তোলেন, রাজ্যের আঞ্চলিক অখণ্ডতার সঙ্গে আপস করা হলে তারা তাদের পুরষ্কার ফিরিয়ে দেবে।
২৯ জুন, ২০২৩। দু’দিনের সফরে মণিপুরে যান তৎকালীন বহিষ্কৃত কংগ্রেস সাংসদ নেতা রাহুল গান্ধী। চুড়াচাঁদপুর, বিষ্ণুপুরে ত্রাণ শিবিরগুলিতে যান তিনি। কথা বলেন ঘরছাড়াদের সঙ্গে। দিল্লি ফেরার আগে কংগ্রেস ভবনে যুযুধান দুই পক্ষ মেইতেই জনগোষ্ঠী এবং কুকি ও নাগা জনজাতির নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন।
৩০ জুন, ২০২৩। রাজ্যে ক্রমাগত হিংসার দায় নিয়ে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। একটি ইস্তফাপত্র লিখেওছিলেন। সেটি নিয়ে রাজভবনের দিকে যাচ্ছিলেন। এমন সময় এক সমর্থক তাঁর ইস্তফাপত্র ছিঁড়ে দেন বলে জানা যায়। তারপর মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ঘোষণা করেন, এই অচলাবস্থার সময় তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেবেন না।
এরপর আসে সেই দিন। ১৯ জুলাই ২০২৩। দুই মহিলাকে নগ্ন হয়ে প্যারেড করানোর ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। ভিডিয়োয় দেখা যায়, প্রকাশ্যে একদল যুবক ওই দুই মহিলাকে যৌন নিপীড়ন করছে। ঘটনাটি অন্তত দু মাস আগের বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়। এই ভাইরাল ছবি দেখেই প্রথমবারের জন্য মণিপুর নিয়ে নীরবতা ভেঙেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওটাই শেষবার। ভিডিয়োটি প্রকাশ হতেই সাড়া দেয় সুপ্রিম কোর্ট। দেশের শীর্ষ আদালত সতর্ক করে দিয়েছিল যে সরকার কাজ করতে ব্যর্থ হলে আদালত হস্তক্ষেপ করবে।
২০ জুলাই, ২০২৩। ওইদিন সপ্তদশ লোকসভায় সংসদের শেষ বাদল অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশন শুরুর আগে সংসদের বাইরে দাঁড়িয়ে মোদী বলেন, ‘মণিপুরের ঘটনা যে কোনও সভ্য সমাজের পক্ষে লজ্জার। ওই ঘটনার জন্য দেশের ১৪০ কোটি মানুষের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। কোনও দোষীকে রেয়াত করা হবে না।’
২৬ জুলাই, ২০২৩। মণিপুর ইস্যুতে ব্যর্থ রাজ্য ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। এই মর্মে লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব আনে বিরোধী ইন্ডিয়া জোট।
৩১ জুলাই, ২০২৩। হিংসার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় ৬০ হাজার এফআইআর-এর বিরুদ্ধে রাজ্য প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চায় সুপ্রিম কোর্ট। প্রশ্ন তোলা হয়, মহিলাদের নগ্ন অবস্থায় প্যারেড করিয়ে প্রকাশ্যে যৌন নিপীড়ণের ঘটনায় এফআইআর দায়ের করতে পুলিশের কেন ১৪ দিন সময় লাগল ?
২৯ জুলাই, ২০২৩। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মণিপুর হিংসার ঘটনার তদন্তভার হাতে নেয় সিবিআই। তারপর তদন্তে যোগ দেয় এনআইএ-ও।
৮ আগাস্ট, ২০২৩। অনাস্থা প্রস্তাবের প্রথম দিনে ইন্ডিয়া জোটের তরফে কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ প্রশ্ন তোলেন, ‘এখনও কেন মণিপুরে যাননি প্রধানমন্ত্রী? মণিপুর নিয়ে ৩০ সেকেন্ডের জন্য মুখ খুলতে কেন ৮০ দিন সময় নিলেন নরেন্দ্র মোদী?’
৯ অগাস্ট, ২০২৩। অনাস্থা বিতর্কের দ্বিতীয় দিনে অংশ নেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি বলেন, ‘আমি বিরোধীদের সঙ্গে একমত যে মণিপুরে হিংসার ঘটনা ঘটেছে। হিংসাকে কেউ প্রশ্রয় দেয় না। তবে এই ইস্যুতে রাজনীতি করা লজ্জাজনক।’
৫ অক্টোবর, ২০২৩। রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কর্মী বাবলু লোইটংবামের বাড়িতে হামলা চলে।
এইভাবে বিক্ষিপ্ত অশান্তির মধ্যেই ২০২৩-এর শেষের দিনগুলিও কেটে যায় মণিপুরবাসীর। রাজ্য ও কেন্দ্রের তরফে তেমন কোনও সদর্থক ভূমিকা নিতে দেখা যায় না। বরং ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের প্রস্তুতিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাজনৈতিক দলগুলি।
এরপর ৩০ জানুয়ারি, ২০২৪। ফের স্থানীয় কুকি-জোমি জাতিগোষ্ঠীর ১০ বিধায়ক পৃথক রাজ্য প্রশাসনের দাবি তোলেন।
এদিকে হিংসা-বিধ্বস্ত মণিপুরের দুটি লোকসভা আসনে দুই দফায় নির্বাচনের ঘোষণা করা হয়। ১৯ এপ্রিল ও ২৬ এপ্রিলে হয় ভোটগ্রহণ। যদিও ওই ভোটে অংশ নেয়নি অধিকাংশ ভোটারই। বরং বিদায়ী সাংসদদের বাড়ির সামনে জমায়েত করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে সাধারণ মানুষ।
৪ জুন, ২০২৪। লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের দিন দেখা যায়, মণিপুরের দুটি আসনেই জয়লাভ করে কংগ্রেস।
২৮ জুলাই, ২০২৪। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৈঠকে কি কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তার সঠিক তথ্য আজও প্রকাশ্যে আসেনি।
মণিপুর স্টিল বার্নিং। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মণিপুর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। একদিকে ১০ শতাংশ ভ্যালি, যা পুরোপুরি মেইতেই জনগোষ্ঠীর দখলে। অন্যদিকে পাহাড়ি এলাকা, যেখানে আদিবাসীরা রয়েছে। এর মাঝে রয়েছে নো ম্যানস ল্যান্ড। যেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন রয়েছে ২৪ ঘণ্টা। পাহাড় থেকে ভ্যালি এলাকায় যেতে গেলে বাফার জোন পেরোতে হবে। যেখানে ৫ রাউন্ড সিকিউরিটি চেক পয়েন্ট রয়েছে। তারপরও ভুল করে যদি ভ্যালিতে কুকি জনজাতির কেউ চলে যায় তার মৃত্যু অবধারিত। আবার পাহাড়ি এলাকায় মেইতেই জনগোষ্ঠীর কেউ এসে পড়লে আর ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত। ইন্ডিয়া-পাকিস্তান বর্ডারের কথা বলছি না। কথা হচ্ছে ভারতেরই এক ছোট রাজ্যকে নিয়ে। দেড় বছর ধরে হিংসা চলছে তো চলছেই।
১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪। সংঘর্ষের ঘটনায় ১১ জনের প্রাণ গিয়েছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, ড্রোন বম্বিংয়েই ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ পথে নামলে রাজ্য সরকার নতুন করে কারফিউ জারি করে দেয়। গত বছরের মতোই বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। কাশ্মীরকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার রেকর্ড গড়ে ফেলেছে মণিপুর।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে গভীর শোকপ্রকাশ করেন কংগ্রেস সাংসদ এ বিমল আকোইজাম। প্রশ্ন তুলে দেন, একই ঘটনা গুজরাতে চললে তিনি কী করতেন। এখন প্রশ্ন উঠছে, কেন এত দীর্ঘ সময় ধরে মণিপুরে অশান্তি চলছে? বিজেপির ডাবল ইঞ্জিন সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে? মণিপুরে এখনও পর্যন্ত কেন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হল না? এই মুহূর্তে মণিপুরে শান্তি ফেরাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
মেইতেই সম্প্রদায়ের দাবি, অসম রাইফেলস পক্ষপাতিত্ব করছে। কুকি জনজাতিকে তারা আড়াল করছে। অসম রাইফেলস-সহ কেন্দ্রীয় বাহিনী দ্রুত সরানোর দাবিতে সরব মেইতেই জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে কুকি জনজাতির মানুষের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় বাহিনীই একমাত্র সংখ্যাগুরু মেইতেই-এর হাত থেকে তাদের রক্ষা করছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী তুলে নিলে তারা কেউ প্রাণে বেঁচে থাকবে না। তবে দুই যুযুধান পক্ষই একসুরে কেন্দ্র সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করে আসছে প্রথম থেকেই। একই প্রশ্ন উঠছে মণিপুরে কবে আসবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী?
এরইমধ্যে বিধানসভা থেকে সমস্ত কুকি জনজাতির বিধায়কদের পদ খারিজের দাবি তোলে মেইতেই জনগোষ্ঠী। কারফিউ না মেনেই কিছু ছাত্র-ছাত্রী রাস্তায় নামে। মুখ্যমন্ত্রী ভবন ও রাজভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখায়। প্রধানমন্ত্রীর ছবি-সহ মুখ্যমন্ত্রীর পোস্টার ছিঁড়ে দেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে।
গত জুলাইয়েও মণিপুরে গিয়েছিলেন কংগ্রেস সাংসদ তথা অষ্টাদশ লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী। তিনি আবারও প্রধানমন্ত্রীকে মণিপুরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু যাওয়া তো দূর, মণিপুর নিয়ে দ্বিতীয়বার আর কথা বলেননি প্রধানমন্ত্রী। যে মেইতেই সম্প্রদায়ের ভরসায় মণিপুরে রাজত্ব চালাচ্ছে বিজেপি, এখন সেই মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষও একই দাবি তুলছে। গোটা ভ্যালিতে কারফিউ জারি নিয়েও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে মেইতেই জনগোষ্ঠীর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে মণিপুরই নরেন্দ্র মোদী সরকারের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ। কিন্তু তেমন কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি কেন্দ্রকে। নির্বাচনের মুখে অনেক রাজ্যেই বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তন করলেও এখনও এন বীরেন সিংকে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরানোর চিন্তা-ভাবনাও করা হয়নি। বাংলায় আরজি কর কাণ্ডের পর যে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে সুর চড়ায়, সেই বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং এখনও বহাল তবিয়তেই শাসনকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন মণিপুরে। বিরোধী দলের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার হলে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে সুবিধা হত। যেহেতু রাজ্যেও বিজেপি সরকার, তাই রাষ্ট্রপতি শাসন জারির পক্ষে সওয়ালও করছে না কেন্দ্র। এখন দেখার আর কবে ক্ষোভ-বিক্ষোভের আগুন নেবে মণিপুরে? আর কবে শান্ত হয় মণিপুর?