মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ অন্ধ্রপ্রদেশের জনপ্রিয় তিরুপতি মন্দিরের প্রসাদী লাড্ডু ঘিরে বিতর্কের জেরে শোরগোল পড়ে গিয়েছে গোটা দেশে। তিরুপতির লাড্ডুতে ঘিয়ের সঙ্গে পশুর চর্বি মেশানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দুর্নীতির কথা শোনা গিয়েছে। কিন্তু ঘি নিয়ে দুর্নীতি এত বড় আকার নেয়নি আগে।
বর্তমানে অন্ধ্রপ্রদেশে রয়েছে চন্দ্রবাবু নাইডুর নেতৃত্বাধীন টিডিপির সরকার। চন্দ্রবাবুর দাবি, তাদের আগে অন্ধ্রপ্রদেশের গদিতে থাকা ওয়াইসআর কংগ্রেসের জগন্মোহন রেড্ডির সরকারের আমলে তিরুপতি মন্দিরে প্রসাদি লাড্ডুতে ভেজাল মেশানো হত। সেখানে পশুর চর্বি মেশানোর অভিযোগ তুলেছেন তিনি। যদিও ওয়াইএসআর কংগ্রেসের তরফে অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশের অমবরাবতীতে এক দলীয় বৈঠকে চন্দ্রবাবু নাইডু এই নিয়ে মুখ খুলেছেন। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু ১৯ সেপ্টেম্বর জানিয়েছেন, ওয়াইএসআর কংগ্রেসের জগন্মোহন রেড্ডি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিরুমালার লাড্ডু বানাতে শুদ্ধ ঘিয়ের বদলে প্রাণীজ চর্বি ব্যবহার করা হত। অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জগন্মোহন রেড্ডি। চন্দ্রবাবু নাইডু গুজরাতের একটি ফুড ল্যাবের রিপোর্ট পেশ করেছেন। রাষ্ট্রীয় ডেয়ারি বিকাশ বোর্ডের অধীনে রয়েছে এই ল্যাবটি। সেই বোর্ড কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ। চন্দ্রবাবু নাইডু জানিয়েছেন, ল্যাবের রিপোর্টে এটা প্রমাণিত যে তিরুপতি মন্দিরের লাড্ডুতে প্রাণীজ চর্বি ব্যবহার করা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী সয়াবিন, সূর্যমুখী, অলিভ অয়েলের পাশাপাশি লাড্ডুতে মাছের তেল, গরুর চর্বি এবং শুয়োরের চর্বির নমুনা মিলেছে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নড্ডা বলেন,’ এবিষয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁর কাছ থেকে বিস্তারিত জেনেছি। রাজ্য নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গেও কথা বলব এবং তদন্ত করব। খাদ্য নিরাপত্তার মানদণ্ড অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিতর্কে সরব হয়েছেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীও। তিনি বলেছেন, যে অভিযোগ উঠছে, সেটা গোটা বিশ্বে তিরুপতির কোটি কোটি ভক্তকে আঘাত করেছে। সব ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করা প্রশাসনের কর্তব্য।
জগন্মোহন রেড্ডি হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত করেছে বলে সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু। এইখানে বলে দেওয়া প্রয়োজন যে, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহন রেড্ডি হিন্দু নন, তিনি খ্রীষ্টান। তিনি ইসাই ধর্মে বিশ্বাসী। ভারতে ইংরেজ শাসন চলাকালীন ১৯৩০-এর দশকে জগন্মোহন রেড্ডির প্রপিতামহ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসাই ধর্মগ্রহণ করেছিলেন। জগন্মোহন রেড্ডিও কখনই নিজের ধর্মকে গোপন করেননি। ২০১৯ সালে ইজরায়েল সফরে গিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহন রেড্ডি। ইজরায়েলের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ঈসা মসীহর জন্ম হয়েছিল। সেখানেই গিয়েছিলেন জগন্মোহন। ইসাই ধর্মের বলেই কি হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত করলেন জগন্মোহন রেড্ডি ? এই প্রশ্নই উঠছে বিভিন্ন মহলে। কিন্তু সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জগন্মোহন রেড্ডি। নিজের পরিবারের দিব্যি দিয়েও বলেছেন যে, এই ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না। কিন্তু চন্দ্রবাবু নাইডু বিষয়টিকে এতটাই বড় করে দিয়েছেন যে ৮৮ শতাংশ হিন্দু বসবাসকারী অন্ধ্রপ্রদেশে জগন্মোহন রেড্ডির রাজনৈতিক জীবন বিপন্নও হতে পারে ।তিরুপতির লাড্ডুর ঘি নিয়ে চন্দ্রবাবু নাইডু এবং জগন্মোহন রেড্ডির মধ্যে বিতর্ক চরমে উঠেছে। যদিও অনেকের মত, এই বিতর্ক আসলে ঘিয়ের নয়, আসলে এটা নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে।
বিতর্কে নাম জড়িয়েছে ভারতীয় ডেয়ারি ব্র্যান্ড আমুলের। বিবৃতি দিয়ে তারা জানিয়েছে, তিরুপতি মন্দিরে তারা কখনও ঘি সরবরাহ করেনি। এরইমধ্যে একটি নির্দেশিকায় রাজ্য সরকার মন্দিরগুলিতে কর্নাটক মিল্ক ফেডারেশনের তৈরি নন্দিনী ব্র্যান্ডের ঘি ব্যবহার করতে বলেছে। রাজ্য মন্দির তদারকি কমিটির আওতায় থাকা ৩৪ হাজার মন্দিরের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে। প্রসাদ তৈরির পাশাপাশি মন্দিরের অন্য কাজেও ওই ঘি ব্যবহার করতে হবে। প্রসাদের গুণমান বজায় রাখতে মন্দিরের কর্মীদের সজাগ থাকার পরামর্শও দিয়েছে চন্দ্রবাবু নাইডুর সরকার।
একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে টিটিডি ট্রাস্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান ওয়াইভি সুব্বারেড্ডি জানান, তিরুপতি মন্দিরের লাড্ডুর জন্য ঘি আনা হত রাজস্থানের ফতেহপুরের একটি ডেয়ারি থেকে। এই ঘিয়ের জন্য ৩ বছরে সংশ্লিষ্ট ডেয়ারিকে ৬০কোটি টাকা দিয়েছে মন্দির কমিটি। প্রতিদিন ৬০কেজি করে ঘি তিরুপতি মন্দিরে পাঠাত ওই ডেয়ারি। সুব্বারেড্ডির সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, ৩বছরে ওই ডেয়ারির থেকে মোট ৬৫ হাজার ৭০০ কেজি ঘি কিনত তিরুপতি মন্দির। তার জন্য তিন বছরে মোট ১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়। অর্থাৎ প্রতি কেজি ঘিয়ের দাম দেওয়া হয়েছে দেড় হাজার টাকা।
তিরুপতি মন্দিরের প্রাক্তন পুজারীর দাবি, তিরুপতির লাড্ডুতে ব্যবহার হওয়া খারাপ মানের ঘি নিয়ে বহুবার সরব হয়েছেন তিনি। মন্দির কমিটিকেও অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি। ঘিতে উদ্ভিজ্জ তেল এবং প্রাণীজ তেল ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ জানিয়েছেন। কিন্তু কখনও তাঁর অভিযোগকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এই মন্দির কমিটির সদস্য হওয়ার প্রাণপন চেষ্টা করেন বড় বড় নেতারা। পরিবারের সদস্যদের এই কমিটির সদস্য করার চেষ্টাও করে থাকেন তাঁরা। তিরুপতি মন্দিরের প্রাক্তন পুজারীর দাবি, তিরুপতি মন্দিরে একটি নিজস্ব ল্যাব রয়েছে। যাতে ঘি সহ প্রসাদ তৈরির জন্য আসা বিভিন্ন সামগ্রী পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় পাশ করলেই তা দিয়ে প্রসাদ তৈরি হয়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, ঘিয়ে যেভাবে প্রাণীর চর্বি মেলানো হয়, তা অনেকসময় ল্যাবের পরীক্ষায় ধরা পড়ে না। আমেরিকার ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন জানিয়েছে, বিশ্বে এমন কোনও টেকনোলজি তৈরি হয়নি, যা দিয়ে প্রাণীজ চর্বি দিয়ে তৈরি ঘিকে যাচাই করা যায়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই বাজারে নকল ঘি বিক্রি হয়। দেশজুড়ে যেসব মিষ্টির দোকানে লাড্ডু বিক্রি হয়। তার নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠালেও হয়তো তাতে প্রাণীজ চর্বি পাওয়া যাবে। কারণ আমাদের দেশে এত পরিমাণ গরু মোষ নেই। এত দুধ তৈরি হয় না যা দিয়ে দেশি ঘি তৈরি করা যেতে পারে।
ভারতে প্রতিবছর প্রায় ২৩হাজার কোটি লিটার দুধ উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ঘি বানানোর জন্য মাত্র ১০শতাংশ ব্যবহার হয়, যা ৭৬কোটি কেজি দুধ। এক কেজি ঘিয়ের জন্য প্রায় ২০-৩০ লিটার দুধের প্রয়োজন। দেশের জনসংখ্যা ১৪৫কোটি। এর মধ্যে অর্ধেক মানুষ ঘি খেলেও প্রতি বছর তাঁদের জন্য ১ বছরে ১ কেজি ঘি বরাদ্দ। যদিও একজন মানুষ এক বছরে প্রায় ৪-৫কেজি ঘি খেয়ে থাকেন। এর থেকেই স্পষ্ট আমাদের দেশে যতটা ঘিয়ের প্রয়োজন। তা উৎপন্ন হয় না। সেজন্যই প্রাণীজ চর্বি ব্যবহার করে নকল ঘি তৈরি করা হয়। এক কেজি নকল ঘিয়ের জন্য – ৫০০গ্রাম প্রাণীজ চর্বি, ৩০০ গ্রাম রিফাইন পাম অয়েল, ফিশ অয়েল, ২০০ গ্রাম আসল দেশি ঘি এবং ১০০ গ্রাম রাসায়নিক মেলানো হয়। এই রাসায়নিক মেলানোর ফলেই নকল ঘিয়ের থেকে আসল দেশি ঘিয়ের মতো গন্ধ বেরোয়।
বাজার থেকে শপিং মল, এমনকি বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যায় এই নকল প্রাণীজ চর্বির তৈরি ঘি। তিরুপতি মন্দিরেও এমনই ঘি ব্যবহার করা হয়েছে। বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সুতরাং এটা নিশ্চয়ই সরকারের নজর এড়িয়ে হচ্ছে না তাও স্পষ্ট।
তিরুমালা মন্দির দেশের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে অন্যতম। যা অসংখ্য মানুষের আস্থার আরেক নাম। এটি ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরের মন্দির। যাকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার বলে গণ্য করা হয়। কথিত আছে, ভগবান ভেঙ্কটেশ্বর যখন পদ্মাবতীর সঙ্গে বিবাহ করছিলেন, তখন আর্থিক সংকটের কারণে ধনদেবতা কুবেরের দ্বারস্থ হন তিনি। তাঁর কাছে এক কোটি টাকা এবং এক কোটি সোনার গিনি চান ভেঙ্কটেশ্বর। মনে করা হয়, ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরের সেই ঋণ পুণ্যার্থীরা মেটাচ্ছেন। সেজন্য পুণ্যার্থীরা মন খুলে দান করেন এই তিরুমালা মন্দিরে। দেশজুড়ে সবচেয়ে ধনী মন্দিরের মধ্যে অন্যতম তিরুমালা মন্দির। এই মন্দিরের প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার কেজি সোনা আছে। ২০১৯-এ দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মন্দিরের ১২হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাঙ্কে রাখা আছে। মন্দিরের নামে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে জমি, বাড়িও কেনা রয়েছে।
মন্দিরের রান্নাঘর ৩০০বছর পুরনো। এত ভক্ত আসেন যে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ লাড্ডু তৈরি করতে হয়। বহু পুণ্যার্থী অনলাইনেও প্রসাদের আবেদন করেন। তিরুমালা ট্রাস্ট প্রতি বছর প্রসাদ বিক্রি করে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আয় করে। তিরুমালা মন্দিরের প্রসাদ নিয়ে ভক্তদের মধ্যে এতটাই উন্মাদনা থাকে যে ২০২৪এর সেপ্টেম্বরে লাড্ডুর জন্য টোকেনের ব্যবস্থা করা হয়। ভগবানের দর্শন করলে একটি লাড্ডু বিনামূল্যে দেওয়া হয়। আরও লাড্ডু চাইলে লাড্ডু পিছু ৫০টাকা করে দিতে হয় ভক্তদের। যাঁরা দর্শন করেননি, তাঁরা আধার কার্ড দেখিয়ে লাড্ডু নিতে পারেন। এর থেকেই স্পষ্ট তিরুপতি মন্দিরের প্রতি ভক্তদের আস্থা ঠিক কতটা। লাড্ডু নিয়ে মামলা এবার সুপ্রিমকোর্টে গড়িয়েছে। শীর্ষ আদালতে কতদিনে এই মামলার নিষ্পত্তি হয়, সেদিকেই তাকিয়ে গোটা দেশ।