পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ কোটা আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ ও রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠা বাংলাদেশ থেকে ৫ অগাস্ট মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা পদ ও দেশ ত্যাগ করেন। এই আবহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙা দিয়ে শুরু হয়েছিল ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ২ মাস পেরোতেই ফের ঝোপ বুঝে কোপ মারলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস। এবার হাত দিলেন মুক্তি যুদ্ধের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে। সোজা কোপ মারলেন বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামি লিগের দাগিয়ে দেওয়া ছুটিগুলোয়।
১৬ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উপদেষ্টা পরিষদ সম্প্রতি এক বৈঠকে ৮টি দিবস বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসের ফেসবুক পেজের পোস্টে জানানো হয় কোন কোন ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
১. ৭ মার্চ: ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ঘোষণা করেন মুজিব।
২. ১৭ মার্চ: মুজিবের জন্মবার্ষিকী বা জাতীয় শিশু দিবস।
৩. ৫ আগস্ট: শেখ হাসিনার ভাই শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী।
৪. ৮ আগস্ট: শেখ হাসিনার মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী।
৫. ১৫ অগাস্ট: মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকী, যা জাতীয় শোকদিবস।
৬. ৪ নভেম্বর: জাতীয় সংবিধান দিবস।
৭. ১৮ অক্টোবর: শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ রাসেল দিবস।
৮. ১২ ডিসেম্বর: স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।
এই দিনগুলির ছুটি বাতিলের ফলে এটা স্পষ্ট, যে ইউনুস কার্যত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথেই এগোচ্ছেন। কারণ চলতি বছর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরেই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিনে, জাতীয় দিবসের ছুটি বাতিল করে ইউনুসের সরকার।তবে এর সমালোচনা এবং তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় হাসিনার দল আওয়ামি লিগের তরফে। তাদের অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকার “রিসেট বোতাম টিপে” বাংলাদেশের সৃষ্টির ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আওয়ামি লিগের দাবি, স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা বাংলা তথা বাঙালির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। তাতে জাতির জনক মুজিবের যে অবদান, তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে। ফেসবুক পেজে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে আওয়ামি লিগ জানিয়েছে, ইউনুসের বাতিল করা এই আটটি জাতীয় ছুটি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণকে চিহ্নিত করে, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এই প্রতিহিংসার রাজনীতির তীব্র ধিক্কার জানায় আওয়ামি লিগ।শুধু জাতীয় ছুটি বাতিলই নয়, বাংলাদেশের ইউনুস সরকার মুজিবকে জাতির জনক মানতেও অস্বীকার করেছে। ইউনুস সরকারে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের দায়িত্বে রয়েছেন নাহিদ ইসলাম। সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি, যার জেরে হাসিনাকে দেশ ছাড়তে হয়। তিনি জানিয়েছেন, আওয়ামি লিগ মুজিবকে নষ্ট করে ফেলেছে। যেভাবে তাঁর মূর্তিপুজো হয়েছে বাংলাদেশে, তা ফ্যাসিবাদী আদর্শের পরিচয় দেয়। গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হয়েছে বাংলাদেশে, সেখানে ফ্যাসিবাদী আদর্শের কোনও জায়গা নেই। প্রত্যেক দেশে একজন জাতির জনক থাকেন। আমাদের থাকবে না। একজন নন, আমাদের অনেক জাতির জনক রয়েছেন, যাঁদের অবদানে এই রাষ্ট্র, স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। একটি দল বা এক ব্যক্তির মধ্যে সবকিছুকে সীমাবদ্ধ করতে চাই না আমরা।” আওয়ামি লিগের চাপিয়ে দেওয়া অপ্রয়োজনীয় জাতীয় দিবসগুলোকে তাই বাতিল করা হয়েছে।
৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার ডাক দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ আরও ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি- তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ বাংলাদেশের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শুনে ফিরে এসে মুজিবকে রাজনীতির কবি আখ্যা দিয়ে কবিতায় লিখেছিলেন—‘সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’ মুজিবের ওই ভাষণকে স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকোও।
১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান চালু হয়। তাতে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি হিসাবে জাতিয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়। ইউনুস সরকার সংবিধান সংশোধন কমিশন গঠন করেছে। অনেকেই দাবি তুলেছেন, সংশোধন নয়, নতুন করে সংবিধান লেখা হোক। ৪ নভেম্বরের ছুটি খারিজ করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের পথেই হাঁটছে ইউনুস সরকার, মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাটা ঘায়ে, নুনের ছিটে ফেলেছে ইউনুস সরকারের সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশজুড়ে মূল্যবৃদ্ধির জেরে মাথায় হাত পড়েছে ওপার বাংলার বাসিন্দাদের। মাত্র একটা ডিম সেখানে বর্তমানে বিকোচ্ছে কমপক্ষে ৩০ টাকায়। দীর্ঘদিন আমদানি-রফতানি বন্ধ থাকায় ধাক্কা খায় ওপার বাংলার বাজার। হু হু করে বেড়েই চলেছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। বেলাগাম গতিতে মূল্যবৃদ্ধিতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন সেখানকার বাসিন্দারা।অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছিলেন মহম্মদ ইউনুস। তবে কী সেটাই ছিল আভাস? সেটাই ছিল ট্রেলার? সিনেমা কি অনতিদূরে? তবে কি বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে যেতে চলেছে ইউনুসের হাত ধরে? এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।