মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর কার্যত তছনছ করা হয়েছে দেশের সরকারি সম্পদ। গণভবনে ঢুকে ভাঙচুর চালিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভের আগুনে প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষজন। নির্বিচারে হত্যালীলা চালানো হয়েছে পদ্মাপারে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে দুর্গাপুজো হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এপার বাংলায় যখন দুর্গোপুজো ঘিরে উৎসবের আমেজ তখন ওপার বাংলায় পুজো ঘিরে আতঙ্ক ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পুজো উদ্যোক্তারাদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দেদার তোলাবাজিও চলছে বলে অভিযোগ। পুজো উদ্যোক্তাদের একাংশের দাবি, মন্দির ও পুজোকমিটিগুলি হুমকি দিচ্ছে, ৫লক্ষ টাকা না দিলে পুজো করতে দেওয়া হবে না। মূলত খুলনাতে প্রায়ই এমনই উড়ো হুমকি চিঠি দেওয়া হয়েছে উদ্যোক্তাদের। প্রশাসনের কাছে এবিষয় নিয়ে অভিযোগ জানালেও, পুলিশের তরফে কোনও সাড়া মেলেনি বলে অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা। যদিও মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার আশ্বাস দিয়েছে যে বাংলাদেশে আগের মতোই দুর্গা পুজো হবে। তা সত্বেও দুর্গাপুজো নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। যদিও ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে তাঁর সরকার নির্বিঘ্নে দুর্গাপুজো পালনের ব্যবস্থা করবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও আশ্বাস দিয়েছেন, শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপুজো করার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক একগুচ্ছ নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছে, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের প্রতি নজর দিতে হবে। এছাড়া পুলিশের টহল বৃদ্ধি এবং পূজামণ্ডপে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে।
বাংলাদেশে দুর্গাপুজো নিয়ে বেশ কিছু ফতোয়াও জারি করা হয়েছে। পুজো উদযাপন পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গির আলম চৌধুরী জানান, দুর্গামণ্ডপগুলির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মণ্ডপে যাতে হামলা না চলে। তার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ করা হবে। যারা মণ্ডপ পাহারা দেবেন। স্থানীয় বাসিন্দা বা পুজোর সঙ্গে যুক্ত যারা, তাদেরই স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে নিয়োগ করা হবে। বিভিন্ন শিফটে তাদের এই দায়িত্বভার দেওয়া হবে।তবে সরকারের একগুচ্ছ নির্দেশিকা সত্বেও ইতিমধ্যে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে বলে সরব হয়েছেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সম্প্রদায় সহ বাংলাদেশের সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোট। জোটের নেতারা বলেছেন, সংখ্যালঘু ও পাহাড়িরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের ওপর প্রতিনিয়ত হুমকি আসছে বলে অভিযোগ তোলেন তাঁরা। প্রতিবাদে শুক্রবার কেন্দ্রীয় ঢাকার শহিদ মিনারে একটি গণ-সমাবেশও করেন তাঁরা। সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেওয়া আট দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশে প্রধান বক্তা চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পরও বাঙালি জাতি একটি আদর্শিক ইতিহাস তৈরি করতে পারেনি। এটি আমাদের জন্য লজ্জার। ভবিষ্যতের জন্য আতঙ্কের। এর নিরসন হওয়া প্রয়োজন।’ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস আরও বলেন, ‘আপনারা বলেছেন, এ দেশে সহিংসতা হচ্ছে না, রাজনৈতিক নিপীড়ন হচ্ছে না। তাহলে দুর্গাপুজোয় কেন মাদ্রাসার ছাত্রদের নামিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন? এতেই স্পষ্ট হয়ে যায় এই দেশের সংখ্যালঘুরা কতটা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন।’
প্রধান উপদেষ্টা তথা নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুসের উদ্দেশে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘পৃথিবীতে আপনি শান্তির বার্তা দিয়েছেন, শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা যদি নিরাপদ না থাকে, এ শান্তি স্থায়ীভাবে বিপন্ন হবে। এই দেশ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। গণতন্ত্র ও সহাবস্থানের জন্য প্রতিটি ধর্মের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারকে সমানভাবে উন্নত করার জন্য উদ্যোগ নিন। ’
বিগত কয়েক বছরে দুর্গাপুজোর মণ্ডপে হামলা চালানোর মতো বহু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। মণ্ডপে ঢুকে প্রতিমা ভাঙচুর, প্রতিমাকে কালিমালিপ্ত করে দেওয়ার মতো নক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। এবার সেইধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে মসজিদে আজানের সময় মণ্ডপে ঢাক-ঢোল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইউনুস সরকারের তরফে। এছাড়া আজানের ৫ মিনিট আগেই মাইক ও যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র বাজানো বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আজান শেষের পরই ফের মাইক বা ঢাক বাজানো যাবে বলে উল্লেখ রয়েছে সেই নির্দেশিকায়। ইউনুস সরকারের এধরণের পদক্ষেপে বাংলাদেশে দুর্গাপুজো নির্বিঘ্নে হয় কিনা, সেটাই এখন দেখার।