পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ গল্পটা বাটি হাতে থেকে স্টেথো হাতের। গল্পটা পিঙ্কি হরিয়ানের। মেয়েবেলায় অবহেলা। অভাবের সংসারে কচি হাতে বাটি উঠেছিল ভিক্ষা চাওয়ার জন্য। চতুর্থ শ্রেণীতেই ডাক্তার হওয়ার উচ্চাকাঙ্খা। একদিকে পেটে খিদের জ্বালায় বাটি হাতে নামতে হত পথে। অন্যদিকে, মনে ছিল বড় হয়ে সেবাপরায়ণ হওয়ার খিদে। তাই ভিক্ষার বাটির পাশাপাশিই তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। কলমের ইচ্ছে ডানায় ভর করে পিঙ্কি হাতে পেলেন স্টেথো। পিঙ্কির ইচ্ছে ও পরিশ্রমেই ঘুচল দারিদ্র্য, ঘরে এলো সুখ-শান্তির আলো। না এটা কোনও রূপকথা নয়। এটা সত্যিকারের কাহিনী। কাহিনীটা হিমাচলের রাস্তায় রাস্তায় বড় হওয়া পিঙ্কির।হিমাচলপ্রদেশের ম্যাকলিওডগঞ্জের পথে আঁস্তাকুড় থেকে খাবার খুঁজে খেতেন পিঙ্কি হরিয়ান। তা না জুটলে চেনা-অচেনা সকলের কাছে হাত পাততেই হত। ভিক্ষা করা থেকে শুরু করে মেডিক্যাল পাশ করা পর্যন্ত, ২০ বছরের চ্যালেঞ্জিং যাত্রা পিঙ্কির। প্রতিকূলতা, সংগ্রাম, অধ্যবসায়, সংকল্প বৃদ্ধি, সাফল্য, বিস্ময়ের আরেক নাম পিঙ্কি হরিয়ান।
সালটা ২০০৪। পিঙ্কিকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ভিক্ষে করতে দেখছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু তথা ধর্মশালার টং লেন চ্যারিটেবল ট্রাস্টের পরিচালক লোবসাং জ্যামইয়াং। বিষয়টি তিব্বতি সন্ন্যাসীর নজরে পড়তেই জীবন বদলে যায় পিঙ্কির। জহুরি চিনে ফেলেছিলেন পিঙ্কির মনে থাকা রত্নভাণ্ডারকে। লোবসাং ঠিক করেন পিঙ্কিকে পড়াশোনা শেখাবেন। ভর্তি করাবেন স্কুলে। এদিকে মেয়েকে স্কুলে পাঠাবেন না বলে অনড় ছিলেন পিঙ্কির বাবা কাশ্মীরি লাল। অনেক তর্ক বিতর্কের পরে গলে যায় বরফ। পিঙ্কির পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের রাজি করান লোবসাং। পিঙ্কির ভিক্ষুক জীবন ছেড়ে শুরু হয় পড়াশোনা। চরণ খুদ এলাকায় ঘিঞ্জি বস্তির এককোণেই ছিল বসবাস। কে জানত সেই একরত্তি মেয়েরই নামের পাশে একদিন এমবিবিএস (MBBS) লেখা হবে।দয়ানন্দ পাবলিক স্কুলে শুরু হয় পিঙ্কির প্রাথমিক পাঠ। চরণ খুদ বস্তির ঠিকানা বদলে পিঙ্কির আস্তানা হয় স্কুলে পথশিশুদের জন্য নির্দিষ্ট হস্টেলে। তারপরই ধীরে ধীরে জীবন বদলে যায় তাঁর। পড়াশোনাই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যানজ্ঞান। একের পর এক পরীক্ষায় সফল হয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন পিঙ্কি হরিয়ান। পিঙ্কির ইচ্ছে তিনি ডাক্তার হবেন। যে চরম দারিদ্র্য, চিকিত্সা পেয়ে মৃত্যু, খিদে, ক্ষয়ে যাওয়া তিনি স্বচোক্ষে দেখেছেন। সেখান থেকেই অনেককে মুক্তির ঠিকানা দেখাতে চান পিঙ্কি। সেই ইচ্ছেকে ফলপ্রসূ করতেই বসেন নিট বা ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স পরীক্ষায়। সফল হলেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল বেসরকারি কলেজের ডাক্তারি পড়ার খরচ। এরপরই ইংল্যান্ডের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ২০১৮তে পিঙ্কিকে চিনে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ করে দেয়। চিন সরকারের তরফে চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার শংসাপত্র পান তিনি।কিছুদিন আগেই ধর্মশালায় ফিরেছেন ডাঃ পিঙ্কি হরিয়ান। তবে লড়াই এখনও থামেনি তাঁর। পিঙ্কি একটি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন যাতে তিনি সহজেই ভারতে গিয়েও চিকিৎসা করতে পারেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন ফরেন গ্র্যাডুয়েট এগজামিনেশনের। এই পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই বিদেশ থেকে ডাক্তারি ছাত্র-ছাত্রীরা ভারতে চিকিত্সা করার ছাড়পত্র পাবেন।
আস্তাকুড়ের ফেলে আসা দিনকে ভোলেনি পিঙ্কি। আস্তাকুড়ের শিশুগুলোও এমবিবিএস পিঙ্কি দিদির প্রতিই আস্থা রেখেছে। পিঙ্কি ওদের কাছে অনুপ্রেরণা। তারাও এখন পিঙ্কির মতোই লেখাপড়া করে দরিদ্র্যসেবাকেই ব্রত করতে চায়। আর পিঙ্কি চান দারিদ্র্যসীমার নীচে, রোগে ভুয়ে ক্ষয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষকে রোগমুক্তির দিশা দেখাতে। দারিদ্র্যকে পরাজিত করে দারিদ্র্য সেবা করা, সঠিক দিশা পেয়ে সঠিক দিশা দেখানো, সহায়তার অপব্যবহার না করে জীবনের গতিপথ বদলে এগিয়ে যাওয়া যায় কীভাবে তা প্রমাণ করে দিলেন ডাঃ পিঙ্কি হরিয়ান।