পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃবছর দুয়েক আগেই ভূমধ্যসাগর গর্জে উঠেছিল ইজরায়েলের কয়েক ডজন যুদ্ধবিমানের তীব্রতায়। ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছিল, দূরপাল্লার ফ্লাইট দিয়ে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তূতে হামলার উদ্দেশ্যেই এই মহড়া। এর মাধ্যমে ইজরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল, তেল আভিভ একার চেষ্টাতেই ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংসের পরিকল্পনা করছে বছরের পর বছর ধরে। তবে ইরান কখনই প্রকাশ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি চালানোর কথা স্বীকার করেনি। তারপরও দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞার বন্যা বয়ে দিয়ে আসছে আমেরিকা।
গবেষণার রিপোর্ট কী বলছে?
২০২২ সালে ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মহম্মদ ইসলামি বলেছিলেন, পরমাণু অস্ত্র বানানোর ক্ষমতা আছে ইরানের। বোমা বানানোর কোনও পরিকল্পনা নেই। এর কিছুদিন আগেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের একজন সিনিয়র উপদেষ্টাও প্রায় একই কথা বলেছিলেন।২০২১ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আই.এ.ই.এ. জানিয়েছিল, ইরান ১ মাসের মধ্যে একটি পরমাণু বোমা বানানোর জ্বালানি উত্পাদনের ক্ষমতা রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় জেনারেল কাসেম সুলাইমানের মৃত্যুর পর ২০২০ সালে ইরান ঘোষণা করেছিল, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, তার কোনওটিই তারা মেনে চলবে না। অবশ্য ওই চুক্তিকে একটি বাজে চুক্তি বলে দাগিয়ে ২০১৮ সালেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।তারপর থেকেই ইরান ক্রমাগত ওই চুক্তিতে আরোপ করা কিছু বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে চলেছে বলে বরাবরই অভিযোগ ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, চিন, জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের।
তা হঠাত্ কী থেকে চাগাড় দিল ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির প্রসঙ্গ?সম্প্রতি এক ভূকম্পন ও ইরান-ইজরায়েলের মধ্য চলা বিরোধ যে চরম উত্তেজনায় পৌঁছেছে তাতে নতুন করে আলোচনার শীর্ষে ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রসঙ্গ।
গত ৫ অক্টোবর একটি মাঝারি ভূমিকম্পন অনুভূত হয় ইরান ও ইজরায়েলে। রিখটার স্কেলে ওই ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৪.৫। উত্পত্তিস্থল ছিল ভূগর্ভ থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে। তবে এটি আসলে ভূমিকম্প নয়, ইরান সম্ভবত পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে বলেই জল্পনা। কারণ গবেষণা বলছে এই ভূকম্পনের উত্সস্থল ইরানের পরমাণু কেন্দ্রের কাছেই ছিল। ইরান অভসার্ভারের এক্স হ্যান্ডেলে দেওয়া বার্তাও তেমনই ইঙ্গিত দেয়। আয়াতুল্লা খামেনেইয়ের প্রতিনিধির বক্তব্য, প্রয়োজন হলে আমরা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করব।সম্প্রতি ইজরায়েলে প্রায় ২০০ মিসাইলের মাধ্যমে হামলাও চালিয়েছে ইরান। পরপর কাকতালীয়ভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর পরই ইরানের পরমাণু কর্মসূচির খবর ফের ট্রেন্ডিংয়ে উঠে আসে।
ইরান ও পরমাণু বোমা নিয়ে সম্ভাব্য প্রশ্নাবলী…
সত্যিই কি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে? সত্যিই কি ইরানের পরমাণু তৈরির সক্ষমতা রয়েছে? দেশটি যদি পুরোদমে পরমাণু কর্মসূচি চালাতে থাকে, তাহলে কত দ্রুত তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ইরানের শত্রু দেশগুলির।কারণ ইরানের হামলা পাল্টা হামলা চালাতে অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে তৈরি হচ্ছে ইজরায়েল। অন্যদিকে ইজরায়েলের পাশে থাকা আমেরিকা বলছে, কোনওভাবেই যেন ইজরায়েল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা লক্ষ্যবস্তূ না করে ইরানের পরমাণু কেন্দ্র এবং তৈল কেন্দ্রকে। যদিও ইজরায়েল যে আমেরিকার সাহায্য ছাড়াই ইরানের ওপর হামলা চালাতে প্রস্তুত তা আগেও বুঝিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে বিপদের আশঙ্কা করছে ওয়াশিংটন। ইরানে ইজরায়েলের হামলার অর্থ, মুখ থুবড়ে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে নিরাপত্তা। কারণ ইজরায়েলের হামলার পর বসে থাকবে না তেহরান। জল, স্থল, আকাশপথ সবদিক থেকে হামলা হবে। ইজরায়েল সহ পুরো পশ্চিম এশিয়ায় মহাযুদ্ধ বেধে যাবে।
গবেষণাভিত্তিক মতামত
সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, বর্তমানে ইরানের হাতে যে পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে তা দিয়ে কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অন্তত ৩ টি পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারবে তেহরান।১৯৮৪ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ জানিয়েছিল, পরমাণু বোমা বানানোর দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছে ইরান।তবে সে সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিল বা এনআইসি জানিয়েছিল, পরমাণু বোমা বানাতে ইরানের আরও কয়েক বছর এমনকি এক দশক লেগে যেতে পারে।ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিউস্টন উডের দাবি, এই বছরের মধ্যে ইরান পরমাণু বোমার সফল বিস্ফোরণ চালাতে সক্ষম হবে না। ইরানের হাতে পর্যাপ্ত পারমাণবিক জ্বালানি এলেও, এক বছরের আগে দেশটি বোমা তৈরি করতে পারবে না।ইন্সটিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটির গত অগাস্টের একটি রিপোর্টে দাবি, ইরান তাদের জ্বালানি পরিশোধনের কাজ এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যাতে মাস নয়, কয়েকদিনের মধ্যেই তারা পরমাণু বোমা বানাতে সক্ষম।গত মার্চের একটি গবেষণায় মার্কিন কংগ্রেসের কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস জানিয়েছিল, একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত পরিশোধিত জ্বালানি পেতে ইরানের বড়জোর এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।তবে মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের প্রাক্তন চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক এ মিলেই-এর বরাত দিয়ে ওই গবেষণায় বলা হয়, সত্যিকারের একটি কার্যকরী পরমাণু বোমা তৈরি করতে ইরানের বেশ কয়েক মাস সময় লেগে যাবে।আর মার্কিন গোয়ন্দা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, আপাতত ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচি অস্ত্র তৈরির দিকে নিয়ে যাচ্ছে না।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ওপর নজর রাখতে রাষ্ট্রসংঘের পরিদর্শক ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এজেন্সির একটি রিপোর্টের উল্লেখ করে মার্কিন কংগ্রেস জানিয়েছিল, ইরানের হাতে এখনও একটি কার্যকর পরমাণু বোমার নকশা কিংবা বিস্ফোরণ ঘটানোর ডেটোনেশন সিস্টেমই নেই।
২০২৩ সালের পয়লা অক্টোবর জেরুজালেম পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইরান ২ সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে পরমাণু বোমার প্রয়োজনীয় উপাদান উত্পাদনে সক্ষম।এমনকি ওই বছরের এপ্রিলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন একটি সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, উত্তর কোরিয়ার সাহায্য নিয়ে ইরান ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পরমাণু হুমকিতে পরিণত হতে পারে।
যদিও ইরানের পরমাণু কর্মসূচির নাগাল পায়নি মোসাদও। কারণ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই পরমাণু কেন্দ্রগুলি। এমনকি ইজরায়েলি হামলা থেকে বাঁচতে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারেও গবেষণা চালায় তেহরান। ফলে আকাশপথে বোমা হামলা বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে সবগুলো ধ্বংস করা ইজরায়েলের পক্ষে কঠিন। অথচ ২২ বছর ধরে ইরানের গুপ্ত এই পরমাণু কেন্দ্রগুলিকেই ধ্বংসের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে ইজরায়েল।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির যাত্রা
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৫০-এর দশকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তির জন্য পরমাণু কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯৫৭ সালের ৫ মার্চ ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে সাক্ষরিত হয়েছিল বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী, ইরানকে কারিগরি সহায়তা ও পরিশোধিত ইউরেনিয়াম সরবরাহ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫৯ সালে গড়ে ওঠে তেহরান পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র। ১৯৬৭ সালে সেখানে প্রথম গবেষণা রিয়্যাক্টর পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৬৮ সালে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি সাক্ষরের পর ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সি আইআইএর সঙ্গে পরমাণু নিরপত্তা চুক্তি করে ইরান। ১৯৭৫-এ তত্কালীন পশ্চিম জার্মানি ইরানের বুশিহরে ১২০০ মেগাওয়াটের লাইট ওয়েটের রিয়্যাক্টরের নির্মাণকাজ শুরু করে। ১৯৭৬ সালে ইরানের ২৩ টি পরমাণু রিয়্যাক্টর তৈরির পরিকল্পনায় সহায়তার ঘোষণাও করেছিলেন তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুর মার্যাদা দিলেও ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লবের পর পাল্টে যায় সবকিছু। তেহরানের গবেষণা কেন্দ্রে জ্বালানি পাঠানো বন্ধ করে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিম জার্মানিও সরে আসে বুশেহর প্রকল্প থেকে। ফলে এরপর কার্যত বন্ধই হয় যায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। কিন্তু ১৯৮০ সালের ইরাকের সঙ্গে শুরু হওয়া ৮ বছর ব্যাপী যুদ্ধ পাল্টে দেয় সব সমীকরণ। ১৯৮২ সাল থেকেই ছোট পরিসরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করেছিল ইরান। ১৯৯০ সালে বুশেহর পরমাণু প্রকল্প ফের চালুর ঘোষণা করে দেশটি। পরমাণু কর্মসূচি চালানোর জন্য ১৯৯২ ও ১৯৯৫ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ২ টি চুক্তিও করে ইরান। ২০১০ সালে ইরানের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট মেহমুদ আহমেদিনিজাদ বলেছিলেন, ইরান ২০ শতাংশ পরিশোধিত ইউরেনিয়াম উত্পাদন করেছে। আরও বেশি মাত্রায় ইউরেনিয়াম পরিশোধনের ক্ষমতা আছে ইরানের। এরপরই ইরানের পরমাণু শক্তিতে লাগাম টানার সিদ্ধান্ত নেয় অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলো। দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৫ বিশ্বশক্তি ও জার্মানির সঙ্গে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সাক্ষরিত হয় গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তি। ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা শীথিল করার বিনিময়ে পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য ইরান তাদের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ বা গবেষণা ও উন্নয়ন সীমিত করার বিষয়ে রাজি হয়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ফের শুরু হয় বিশ্বজুড়ে সঙ্কট। পরমাণু বোমা তৈরির জন্য উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম যথেষ্ট পরিমাণে হাতে পেতে যে সময় লাগে অর্থাত্ নিউক্লিয়ার ব্রেকআউট। বিশ্ব শক্তিগুলোর জন্য উদ্বেগের বিষয় হল ইরানকে থামানোর জন্য এই সময়টুকু আদৌ হাতে আছে কিনা।